সিন্ডিকেটের হাতেই নিয়ন্ত্রণ, চট্টগ্রামে সিলিন্ডার গ্যাস নিয়ে চলছে নৈরাজ্য

লিকুইফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) সিলিন্ডার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে সাধারণ ভোক্তা। সরকারি নির্ধারিত দামের চেয়ে বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে গ্যাস সিলিন্ডার। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ ক্রেতারা।

এদিকে চলতি বছর জানুয়ারি ও মার্চে এলপিজি সিলিন্ডারের দাম দুদফা কমিয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। তবে কোথাও সেই দামে গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে না। এখনও বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে সিলিন্ডার।

ভোক্তারা বলছেন, দাম কমিয়ে দায় সেরেছে কর্তৃপক্ষ। তবে এ নিয়ে মাঠে কোনো সংস্থার তদারকি নেই। ফলে ফায়দা লুটছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।

সাধারণত বাসা-বাড়িতে রান্নার জ্বালানি হিসেবে ১২ কেজি ওজনের এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের নগরজুড়ে রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। তবে হোটেল-রেস্টুরেন্টে ৩৫ কেজি ওজনের এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার বেশি।

নগরের বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, এলপি গ্যাসের খুচরা দোকানগুলোতে ওমেরা, বেক্সিমকো, টোটাল ও বসুন্ধরা কোম্পানির ১২ কেজি ওজনের প্রতিটি এলপি গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকায়। স্থানভেদে বিভিন্ন অলিগলির দোকানে ১ হাজার ৮০০ টাকায় পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। ফ্রেশ, যমুনা, বিএম, ইউরোগ্যাজ, ইউনিগ্যাস, জেএমআই গ্রুপের ১২ কেজি ওজনের এলপি গ্যাসের প্রতিটি সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত।

এছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির ৩৫ কেজি ওজনের সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ২০০ থেকে ৪ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত।

আরও পড়ুন: মেয়াদ ছাড়াই ওষুধ বেচে আইডিয়াল ফার্মেসি, গলাকাটা দাম ষোলশহরে গ্যাস সিলিন্ডারের

গত ২ মার্চ ভোক্তা পর্যায়ে ৭৬ টাকা কমিয়ে ১২ কেজি ওজনের প্রতিটি এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণ করা হয় ১ হাজার ৪২২ টাকা। যদিও বিইআরসি’র এ মূল্য নির্ধারণের সিদ্ধান্ত কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। ব্যবসায়ীরা সেই সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ক্রেতাদের কাছ থেকে প্রতি সিলিন্ডারে প্রায় ২৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বেশি আদায় করছে।

চকবাজার ডিসি রোড এলাকার বাসিন্দা ও বেসরকারি চাকরিজীবী হাবিবুর রহমান আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, সরকারিভাবে এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। অথচ এ পর্যন্ত কোনো মাসেই নির্ধারিত দামে দোকান থেকে গ্যাস সিলিন্ডার কিনতে পারিনি। প্রায় ৩০০-৪০০ টাকা বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। দাম কমিয়ে দায় সেরেছে কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়টি সরকারের গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত।

সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বাড়তি দামে এলপি গ্যাস বিক্রির কারণ জানতে চাইলে ‘আশা ট্রেডার্স’-এর স্বত্বাধিকারী রায়হান উদ্দিন বলেন, আমরা বরং কেনা দামের চেয়ে ৫০/১০০ টাকা কমে বিক্রি করছি। এটি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় মিথ্যা লেখা হচ্ছে।

এরপর একই দোকানে ২০ মিনিট পরে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। এ সময় এক ক্রেতার কাছ থেকে টোটাল কোম্পানির ১২ কেজির একটি এলপি গ্যাস সিলিন্ডার ১ হাজার ৬০০ টাকা নেন প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার রায়হান উদ্দিন। অর্থাৎ সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ১৭৮ টাকা বেশি নেওয়া হয়েছে।

পরে কারণ জানতে চাইলে সুর পাল্টে রায়হান উদ্দিন বলেন, দেশে সবকিছুর দাম বেড়েছে। যেদিকে যাই সেদিকেই দাম বাড়তি। গ্যাসে বাড়লে শুধু সমস্যা।

২০২১ সালের ১২ এপ্রিল দেশের বাজারে প্রথমবারের মতো এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে বিইআরসি। এরপর থেকে সৌদি সিপিকে ভিত্তিমূল্য ধরে প্রতি মাসে ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রির জন্য এলপি গ্যাসের মূল নির্ধারণ করে দিচ্ছে সংস্থাটি। দেশে বিভিন্ন দেশ থেকে এলপি গ্যাস তৈরির মূল দুই উপাদান প্রোপেন ও বিউটেন আমদানি করা হয়। প্রতি মাসে এ দুই উপাদানের মূল্য প্রকাশ করে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠান ‘আরামকো’। একেই সৌদি কার্গো মূল্য বা সৌদি সিপি বলা হয়। যার ভিত্তিতে বিইআরসি দেশে প্রতি মাসে এলপি গ্যাসের দাম সমন্বয় করে।

জানা যায়, চলতি বছরের ২ জানুয়ারি ৬৫ টাকা কমিয়ে ১২ কেজির সিলিন্ডারের দাম ১ হাজার ২৩২ টাকা নির্ধারণ করে বিইআরসি। এরপর গত ২ ফেব্রুয়ারি ২৬৬ টাকা বাড়িয়ে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণ করা হয় ১ হাজার ৪৯৮ টাকা।

সর্বশেষ ২ মার্চ ৭৬ টাকা কমিয়ে প্রতিটি সিলিন্ডারের খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১ হাজার ৪২২ টাকা। তবে বাজারে দাম কমার প্রভাব পড়েনি। সাধারণ ক্রেতারা নির্ধারিত দামের চেয়ে ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা বেশি দামে কিনছেন সিলিন্ডার।

এ বিষয়ে জানতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলার সহকারী পরিচালক নাসরিন আক্তারের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, অতিরিক্ত দামে এলপি গ্যাস বিক্রির কারণে আমরা সারাদেশে সরকারিভাবে এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণের জন্য হাইকোর্টে রিট করেছিলাম। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের এপ্রিল মাস থেকে প্রতি মাসে এলপি গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করে আসছে বিইআরসি। তবে শুধুমাত্র দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার মধ্যেই বিইআরসির কাজ সীমাবদ্ধ। নির্ধারিত দর বাজারে ভোক্তা পর্যায়ে কার্যকর হচ্ছে কি-না সেই বিষয়ে তাদের কোনো তদারকি নেই।

তিনি বলেন, বিইআরসির দায়িত্বহীন আচরণের কারণে ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে এলপি গ্যাস বিক্রি করতে পারছে। ভোক্তারাই যদি কোনো সুবিধা না পায় তাহলে সরকারিভাবে দাম নির্ধারণ করে দিয়ে লাভ কী? বিইআরসি চাইলে জেলা প্রশাসন বা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে যথাযথ নির্দেশনা দিয়ে বিষয়টি তদারকি করতে পারে।

তিনি আরও বলেন, আমরা বিইআরসিকে নির্ধারিত দাম ঠিকভাবে কার্যকর হচ্ছে কি-না তা তদারকির জন্য বলে এসেছি। সাধারণ মানুষ বর্তমানে ব্যবসায়ীদের কাছে অসহায় হয়ে গেছে। এখন গ্রামাঞ্চলেও গ্যাসের চুলা ব্যবহার বেড়েছে। সারাদেশে এলপি গ্যাসের এক দাম কার্যকরে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

আরবি/আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!