এবার সত্যি সত্যিই সাঁঝবেলাটা রাঙাতে চলেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ

আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত সৈনিকদের একজন মো. ইউনুছ। বারবার জেলে পাঠিয়েও তাঁকে এক মুহূর্তের জন্য বিচ্যুত করা যায়নি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে। পাওয়া—না পাওয়ার হিসাব তিনি কখনোই করেননি। সবসময় চেয়েছেন দলের জন্য নিজের সর্বোচ্চটা দিতে।

সেই ইউনুছকে নিয়েই ২০২২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বিশেষ প্রতিবেদন করে আলোকিত চট্টগ্রাম। যার শিরোনাম ছিল— “একাত্তরের বীর, জেলে জেলেই কেটেছে জীবন—সাঁঝবেলাটা কি রাঙাতে পারবেন চট্টগ্রামের ইউনুছ?”

দেড় বছর পর সত্যিই সাঁঝবেলাটা রাঙাতে চলেছেন ইউনুছ। এ বীর মুক্তিযোদ্ধাকেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পদে। বুধবার (২৪ এপ্রিল) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চুক্তি ও বৈদেশিক নিয়োগ শাখার উপসচিব ভাস্কর দেবনাথ বাপ্পি স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১৮ এর ধারা-৭ অনুযায়ী মোহাম্মদ ইউনুছকে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সঙ্গে কর্ম-সম্পর্ক পরিত্যাগের শর্তে যোগদানের তারিখ থেকে পরবর্তী ৩ (তিন) বছর মেয়াদে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ প্রদান করা হলো।
আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের তালিকা করলে শুরুতেই থাকবে ইউনুছের নাম। কিন্তু কিছু পাওয়ার তালিকায় তাঁর নামটি না থাকায় হতাশ হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের সচেতন মহল।

আরও পড়ুন : একাত্তরের বীর, জেলে জেলেই কেটেছে জীবন—সাঁঝবেলাটা কি রাঙাতে পারবেন চট্টগ্রামের ইউনুছ?

আওয়ামী লীগে একটি কথা প্রচলিত আছে— “বঙ্গবন্ধুকন্যা (শেখ হাসিনা) নাকি দলের ত্যাগী নেতাদের কখনোই বঞ্চিত করেন না।” বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ সিডিএর চেয়ারম্যান হওয়ায় পুরনো সেই কথাটিই যেন নতুন করে ফের সামনে এলো।

শুরুটা যেখানে

১৯৫৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি হাটহাজারীর নুর আলী মিয়ার হাট ফরহাদাবাদ গ্রামের হিম্মত মুহুরী বাড়ীতে জন্ম নেন ইউনুছ। তাঁর বাবা মরহুম নুর হোসেন ছিলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক উচ্চতর হিসাব কর্মকর্তা।

উত্তাল একাত্তরে তিনি চট্টগ্রাম পূর্বাঞ্চলের সম্মুখযোদ্ধা ছিলেন। চট্টগ্রাম কারাগার থেকে বি.কম পরীক্ষায় অংশ নিয়ে তিনি ডিগ্রি পাস করেন।

১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঐতিহাসিক লালদিঘীর ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় পাকিস্তানের পতাকা আগুনে জ্বালিয়ে দেন ইউনুছ। পরদিন ৩ মার্চ বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে তিনি চট্টগ্রামের রাজপথ প্রদক্ষিণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধে ইউনুছ

২ মাস ৬ দিন ধরে শারীরিক নির্যাতন সহ্য করে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে পালিয়ে ভারত পাড়ি দেন ইউনুছ। ভারতের উত্তর প্রদেশ দেরাদুন তানদুয়ায় ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধের সামরিক প্রশিক্ষন নেন তিনি। উচ্চতর গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন ইউনুছ।

জেলে জেলেই জীবন

১৯৬৯ সালে গ্রেপ্তার হয়ে ১৫ দিন কারাগারে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি বাতিলের আন্দোলনে যুক্ত থেকে পাকিস্তান সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে ৯ মাস সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯৭৬ সালে ‘বিশেষ সামরিক আদালত- ৪’ এ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলায় ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৮০ সালের ১ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দিজীবন কাটান। চার বছরের কারাজীবনে দুবছর কাটিয়েছেন কনডেম সেলে।

বঙ্গবন্ধুকন্যার সঙ্গে সাক্ষাৎ

১৯৮০ সালে কারাগার থেকে মুক্তির পর একাধিকবার দিল্লি যান। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তিনি দিল্লির পানদার রোডের বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। এরপর দেশে ফিরে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এতে সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন ডা. এসএ মালেক।

জননেত্রী শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত কর্মী হিসেবে সবসময় সঙ্গে ছিলেন। সঙ্গে আরো ছিলেন যুবলীগ নেতা আবুল কাশেম মন্টু (সুত্রাপুর), ছাত্রনেতা হুমায়ন, জাহেদ প্রমুখ। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে পরিকল্পিত আক্রমণের সময়ে সার্বক্ষণিক নেত্রীর সঙ্গে ছিলেন তিনি।

স্কুল সভাপতি থেকে নগর সভাপতি

বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ ১৯৬৮ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল হাই স্কুল ছাত্রলীগ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা সর্বদলীয় মাধ্যমিক স্কুল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ছিলেন। ১৯৭০ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সহসাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২-৭৩ সালে চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত দুমেয়াদে চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দী অবস্থায় চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮০ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন।

এরপর ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত দুবার বাংলাদেশ ছাত্রলীগ জাতীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহসম্পাদক হন। ১৯৮৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন।

এখন তিনি…

বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ বর্তমানে চট্টগ্রাম মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পরিষদের মহাসচিব এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ যোদ্ধা ফোরাম ‘৭৫ এর আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এছাড়া তিনি চট্টগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ বিদ্যালয় শিক্ষা বোর্ড সদস্য, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য, চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালের আজীবন সদস্য, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, চট্টগ্রাম জেলার আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী সমিতির আজীবন সদস্য, চট্টগ্রাম শহর সমাজসেবা প্রকল্প সমন্বয় পরিষদ- ১ এর আজীবন সদস্য এবং পৌর জহুর হকার মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক। সর্বশেষ তিনি সিডিএ চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেলেন।

আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!