যে কারণে হালদায় মরছে মা মাছ—ডলফিন

বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সমন্বয় ও তদারকির অভাবে হালদা নদীতে বেড়েছে দূষণ এবং মা মাছ ও ডলফিনের মৃত্যু। চোরেরা নির্বিচারে মাছ ও ডলফিন শিকার করছে। কলকারখানা ও খামারের বিভিন্ন দূষণে হালদায় প্রতিদিন মাছ ও ডলফিনের মৃত্যু হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এশিয়ার মিঠাপানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননকেন্দ্র তদারকির অভাবে শিকারিরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

প্রতিবছর ডিম সংগ্রহের সময় (এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে জুন পর্যন্ত) ছাড়া দেখা মেলে না মৎস্য বিভাগের কর্তাদের। জেলা মৎস্য বিভাগে পুরো চট্টগ্রামে ৫ জন ও হাটহাজারীতে ২ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। এরমধ্যে হাটহাজারীর একজন ছয় মাসের ট্রেনিংয়ে আছেন।

স্থানীয় চিহ্নিত জেলে ও মাছ চোররা প্রতিদিন ঘেরা জাল, বিষ ঢেলে ও বড়শি বসিয়ে মা মাছ ও ডলফিন শিকার করছে। এছাড়া ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলাচল নিষিদ্ধ হলেও থেমে নেই বালু উত্তোলন। ফলে ইঞ্জিনচালিত নৌকার আঘাতে মারা পড়ছে মা মাছ ও ডলফিন।

হালদা নদীর দেখভালের দায়িত্ব মৎস্য অধিদপ্তর, বন বিভাগ, জেলা প্রশাসনসহ অন্যান্য সংস্থার হলেও জেলা প্রশাসন ও নৌ পুলিশ ছাড়া তেমন কারো তৎপরতা দেখা যায় না। মৎস্য কর্মকর্তাদের বছরে একবার ডিম সংগ্রহের সময় দেখা মিললেও পুরো বছর আর খবর থাকে না। বন বিভাগের তো দেখাই মিলে না। অন্যদিকে উপজেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়ে জাল ও মরা মাছ উদ্ধারে ব্যস্ত।

আরও পড়ুন: সাতসকালে হালদায় ৩ ঘণ্টার অভিযান, উদ্ধার হলো ২০ হাজার মিটার ঘেরা জাল

সূত্র জানায়, ২০২১-২০২২ (জুলাই) এক বছরে ৬৮টি অভিযানে মাত্র দুজনকে ১৫ দিন ও একমাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তাই মাছ চোরেরা চিহ্নিত হলেও স্থানীয় প্রতিনিধিদের যুক্ত না করার কারণে ধরা পড়ে না। কারণ মাছ শিকারিরা মূলত রাত ও ভোরের সময় নদীর নির্জন জায়গায় জাল বসান। মাছ চোরেরা স্থানীয় ও চিহ্নিত। তাই নদীর পাড় এলাকায় তৎপরতা বাড়াতে হলে মাঠ পর্যায়ে যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। হালদার দেখভালে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের যুক্ত করা গেলে মাছ শিকারিদের আইনের আওতায় আনা সহজ হবে।

অন্যদিকে অক্সিজেন আবাসিক এলাকা, বটতল ও আশপাশের কলকারখানার বর্জ্য বানশাহী খাল কুয়াইশ হয়ে হালদাতে গিয়ে পড়ে। একইভাবে বড়দিঘী পাড়ের ইছামতী ও কাটাখালী খাল হয়ে রাসায়নিক বর্জ্য হালদায় গিয়ে পড়ছে। এছাড়া হালদা নদীর আশপাশ এলাকায় অন্তত কয়েকশ গরুর খামার রয়েছে। যার কোনোটিতে নেই ইটিপি। এসব খামারের গোবরের বর্জ্য সরাসরি বা সংযুক্ত খাল হয়ে হালদায় পড়ছে। এছাড়া কুয়াইশ নজুমিয়াহাট বামনশাহী খাল হয়ে দূষণ বাড়লেও পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো খবর নেই।

আমানবাজারের পূর্বে বাথুয়া (সোনা তোয়ান্নের দোকান) এলাকায় ফয়েজ এগ্রোর কয়েকশ গরুর বর্জ্য লালচন্দ্রবিল হয়ে হালদায় গিয়ে পড়ছে। বর্জ্যের গন্ধে টিকতে পারছে না আশপাশের বাসিন্দারা।

জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের তথ্যমতে, উত্তর চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ৩৮৯টি, রাউজানে আছে ৪৩৪টি এবং ফটিকছড়িতে কয়েকশ গরুর খামার রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১ জুন হালদা নদীর আজিমের ঘাট এলাকা থেকে ১২ কেজি ওজনের মৃত কাতলা মাছ, ২৫ জুলাই কাগতিয়া স্লুইস গেটের পাশে প্রায় ৯ কেজির ডিমওয়ালা কাতলা মরা মাছ উদ্ধার করা হয়।

মঙ্গলবার (২৬ জুলাই) সকালে গড়দুয়ারা এলাকা থেকে প্রায় ১০ কেজি ও বিকেলে সাত্তারঘাট এলাকা থেকে প্রায় ১০ কেজি ওজনের দুটি মরা মাছ উদ্ধার করা হয়।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ছয় মাসে হালদা নদীতে ১৮টি মৃত ডলফিন পাওয়া যায়। এছাড়া ২০১৮ সালের মার্চ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ১০টি মৃত ডলফিন পাওয়া যায়। ২০২১ সালে মোট ৫টি মৃত ডলফিন পাওয়া যায়। চলতি বছরেও ৫টি মৃত ডলফিন পাওয়া গেছে।

সর্বশেষ ২১ জুলাই সকালে হালদার আজিমের ঘাট এলাকা থেকে প্রায় ৭ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ৬০ কেজি ওজনের ৩৮তম, ২০ জুলাই দুপুরের দিকে একই এলাকা থেকে ৩৭তম এবং গত ১৪ জুলাই হালদার সংযোগ খাল বুড়িসর্তায় ৩৬তম মৃত ডলফিনটি উদ্ধার করে।

আরও পড়ুন: আঘাতের চিহ্ন নেই—হালদায় হঠাৎ ভেসে উঠল ১২ কেজির কাতলা

হালদা গবেষক ও সংশ্লিষ্টদের মতে, হালদাকে বাঁচাতে হলে হালদা দেখভালের দায়িত্ব সকল বিভাগে সমন্বয় করতে হবে। এছাড়া হালদা পাড়ের আশাপাশের জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয় করে মাছ ও ডলফিন শিকার এবং দূষণ বন্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের আইনের আওতায় আনা না গেলে শিকার ও দূষণ বন্ধ হবে না।

নদী গবেষক ড. ইদ্রিস আলী বলেন, বর্তমানে হালদা বাঁচানোর নামে যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে তার কোনোটি হালদার প্রাণ ও প্রকৃতি রক্ষা করে না। হালদায় উপরের দিক থেকে পানি আসা বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে বৃষ্টিও কম হচ্ছে। তাই হালদায় পানির স্রোত কমে গেছে। হালদা নদীর আশপাশে মানুষের বিচরণ বেড়ে গেছে। এছাড়া আশপাশের কৃষি জমিতে সার ব্যবহারও অন্যতম কারণ। এসব কারণে মা মাছ ও ডলফিন মারা যাচ্ছে। তবে বয়সের কারণেও ডলফিনসহ অন্যান্য মাছ মারা যেতে পারে। তাই হালদাবান্ধব পদক্ষেপ নিতে হবে।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, আমাদের লোকবল সংকট রয়েছে। আমাদের একজন কর্মকর্তা ট্রেনিংয়ে আছেন। গত কয়েকদিন ধরে হালদায় মাছ মারা যাওয়ার উত্তর দিতে দিতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমরাতো আর হালদার পাড়ে গিয়ে বসে থাকতে পারি না। হালদাপাড়ের লোকজন মাছ চুরি করে। তারা আমাদের কোনো সহায়তা করে না। আমরা এখন কী করতে পারি?

হালদাপাড়ের বসবাসকারীদের সচেতনতার বিষয়ে জানতে চাইলে মাদার্শা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. সরওয়ার আলম বলেন, হালদায় মাছ শিকারিদের বিরুদ্ধে আমি সরব। আমার এলাকায় পাহারাদার বসিয়েছি। তবে হালদাপাড়ের জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে হালদা রক্ষা কমিটি করা গেলে প্রতিরোধ ব্যবস্থা আরো মজবুত হবে।

এসআর/আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!