যে কারণে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলরুটে একের পর এক দুর্ঘটনা

চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনে ট্রেন চলছে ঝুঁকি নিয়ে। কম্পিউটার বেজড ইন্টারলকিং সিস্টেম (সিবিআইএস) সুবিধা চালু না হওয়ায় এখনও ম্যানুয়াল সিগন্যাল পদ্ধতিতে চলছে একাধিক ট্রেন। এতে একের পর এক ঘটছে দুর্ঘটনা। বাড়ছে বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকিও।

সংশ্লিষ্টদের মতে, যাত্রী চাহিদার তুঙ্গে থাকা দোহাজারী-কক্সবাজার রুটে বয়স্কদের দিয়ে স্টেশন পরিচালনা, অদক্ষতা ও সক্ষমতার বেশি ট্রেন চলাচলের কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে।

রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানান, সরকারের নির্দেশ ও যাত্রী চাহিদার কারণে ঢাকা-কক্সবাজার রুটে একাধিক ট্রেন চলছে। তবে সিবিআইএস পদ্ধতি চালুর আগে আর কোনো নতুন ট্রেন চালু করা হবে না।

জানা গেছে, গত ২৬ এপ্রিল বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিয়ে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম ছেড়ে আসা পর্যটক এক্সপ্রেস ট্রেনটি দুপুর ২টা ২৫ মিনিটে পটিয়া স্টেশনে পৌঁছায়। একইদিন কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসা কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনটি ২টা ৪০মিনিটে পটিয়া স্টেশনে পৌঁছায়। ট্রেন দুটি ক্রস করার জন্য স্টেশনের লুপ ও মেইন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে।

এদিকে পটিয়া স্টেশনে ৪০ বগির দুটি ট্রেন ক্রস করার মতো সক্ষমতা ছিল না। পরে ট্রেন দুটি পটিয়া স্টেশনে ক্রস না করে পাহাড়তলী কন্ট্রোল অফিসের সিদ্ধান্তে দোহাজারী পৌঁছে ক্রসিং করে। দুপুর ৩টা ১০ মিনিটের দিকে সহস্র যাত্রীসহ কক্সবাজার এক্সপ্রেস ঝুঁকি নিয়ে ১৭ কিলোমিটার পেছনে গিয়ে দোহাজারী স্টেশনে যায়।

এর আগে ২৪ এপ্রিল সকাল ৭টার দিকে এক হাজার যাত্রী নিয়ে ‘ঈদ স্পেশাল’ ট্রেনটি কক্সবাজারের উদ্দেশ্য রওনা দেয়। সাড়ে ৯টার দিকে ট্রেনটি চকরিয়া এলাকার ডুলাহাজার স্টেশনে প্রবেশের আগমুহূর্তে ইঞ্জিনসহ তিনটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এসময় গতি কম থাকায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায় হাজারো যাত্রী। দুর্ঘটনার পর ট্রেনের অধিকাংশ যাত্রী বিকল্প পথে কক্সবাজার রওনা দেন। এর আগে মার্চ মাসে চকরিয়া-ডুলাহাজারা এলাকায় একটি ইঞ্জিন পাথরবাহী টেম্পিং কারকে ধাক্কা দেয়। এছাড়া বিভিন্ন সময় আরও ছোট ছোট দুর্ঘটনা ঘটেছে।

ঈদ স্পেশাল ট্রেনের ইঞ্জিনসহ তিনটি বগি লাইনচ্যুতের ঘটনার দুদিন পর এক হাজার যাত্রীর জীবন ঝুঁকিতে ফেলে উল্টোপথে ১৭ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয় কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনটি। এরপর নড়েচড়ে বসে কর্তৃপক্ষ। সিদ্ধান্ত হয় সিবিআইএস পদ্ধতি চালুর আগে আর কোনো নতুন ট্রেন চালু না করার।

রেলওয়ে সংশ্লিষ্টদের মতে, এক হাজারের বেশী যাত্রীসহ একটি ট্রেন ১৭ কিলোমিটার উল্টো পথে যাওয়ার ঘটনা বিরল। প্রকৌশল বিভাগের অদক্ষতার কারণে নজিরবিহীন এ ঘটনা ঘটেছে। ৪০ বগির দুটি ট্রেন পটিয়া স্টেশনে ক্রসের সক্ষমতা নেই তা কন্ট্রোল ও প্রকৌশল বিভাগের জানা ছিল। এরপরও তারা স্টেশন মাস্টারকে ট্রেন পটিয়ায় ক্রসের নির্দেশনা দেয়।

জানা যায়, গত বছরের ১ ডিসেম্বর উদ্বোধনের পর যাত্রীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুট। এই রুটে বর্তমানে কক্সবাজার এক্সপ্রেস ও পর্যটক এক্সপ্রেস নামে দুটি ট্রেন চালু রয়েছে। এ বছর যাত্রী চাহিদার কথা বিবেচনা করে ‘ঈদ স্পেশাল’ নামে আরও দুটি ট্রেন চালু করা হয়। তবে দোহাজারী-কক্সবাজার রুটে একাধিক ট্রেন চলাচল করলেও নেই স্মার্ট সিগন্যাল ব্যবস্থা। এছাড়া স্টেশনগুলোতে অন্যান্য সুবিধাও চালু হয়নি। প্রকল্প এখনও বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি রেলওয়েকে। সিবিআইএস ও অন্যান্য সুবিধা চালু না হওয়ায় এই রুটে ঝুঁকি নিয়ে চলছে একাধিক ট্রেন।

এছাড়া লোহাগড়া, হারবাং, ডুলাহাজারা ও রামু স্টেশনের কার্যক্রম চলছে প্রকল্পের অস্থায়ী মাস্টার দিয়ে। তাদের সবাই অবসরপ্রাপ্ত হওয়ায় অনেকের বয়স সত্তরের কোটায়। বয়স্কদের দিয়ে স্টেশন চালাতে গিয়ে বেড়েছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি।

সাতকানিয়া ও ইসলামাবাদ স্টেশন এখনও চালুই হয়নি। এছাড়া অনেক স্টেশনে নেই দুটি ট্রেন ক্রস করার জন্য পর্যাপ্ত লুপ লাইন, স্থায়ী বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, নিরাপত্তা বাহিনী, আবাসন ও আসবাবপত্র। এতে কর্মচারীদের কাজে বিঘ্ন ঘটে বিভিন্ন সময় ঘটছে দুর্ঘটনা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের একাধিক কর্মকর্তা, চালক ও গার্ড জানান, সিবিআইএস ছাড়াই একটি ব্যস্ত রুটে চলছে ট্রেন। নিয়োগ হয়নি স্থায়ী কর্মচারী। প্রকল্পের স্টেশন মাস্টারদের বেশিরভাগই বয়স্ক। নেই আবাসনসহ অন্যান্য সুবিধা। এরমধ্যে চলছে ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে ট্রেন। এতে একাধিক দুর্ঘটনা ঘটলেও আগামীতে আরও বড় ধরণের দুর্ঘটনার শঙ্কা রয়েছে। তাই রেলপথ পুরোপুরি উপযোগী হওয়ার পর পর্যাপ্ত দক্ষ কর্মচারী নিয়োগের পর ট্রেন সংখ্যা বাড়ালে সমস্যা নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিভাগীয় ব্যবস্থাপক মো. সাইফুল ইসলাম আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, দুর্ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কক্সবাজার রুটে যাত্রী চাহিদা ব্যাপক। সরকারের নির্দেশে একাধিক ট্রেন চালু করা হয়েছে। তবে স্মার্ট সিগনাল পদ্ধতিসহ পুরো কাজ শেষ হতে জুন পর্যন্ত সময় লাগবে। স্মার্ট সিগনাল চালুর আগে আর কোনো নতুন ট্রেন চালু করা হবে না।

বিভাগীয় প্রকৌশলী-১ মো. আবদুল হানিফ বলেন, দোহাজারী-কক্সবাজার রুটে স্মার্ট সিগনাল পদ্ধতিসহ কিছু কাজ বাকি রয়েছে। তবে এই রুটে একাধিক ট্রেন চলাচলের জন্য সক্ষম। কিছু দুর্ঘটনা ঘটলেও এই রুটে একাধিক ট্রেন চলাচলে কোনো সমস্যা নেই।

যোগাযোগ করা হলে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলওয়ে প্রকল্পের অতিরিক্ত পরিচালক মো. আবুল কালাম চৌধুরী আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, দোহাজারী-কক্সবাজার রেলওয়ে প্রকল্পর কাজ শেষ পর্যায়ে। একটি স্টেশনের লুপ লাইন ও স্টেশনের ছোটখাটো কিছু কাজ বাকি রয়েছে। স্মার্ট সিগনাল পদ্ধতির কাজও প্রায় শেষদিকে। আশা করি আগামী ১ জুন কাজ বুঝিয়ে দিতে পারবো।

আরবি/আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!