‘মৃত্যুর কূপ’ মিরসরাইয়ের অপরূপ পাহাড়ি ঝরনা, বাতিল হচ্ছে ইজারা

মিরসরাইয়ে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য পাহাড়ি ঝরনাগুলো এখন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে! উপজেলার সাতটি পাহাড়ি স্পটে গত ৫ বছরে ঘুরতে এসে ১৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। বন বিভাগ ও ইজারাদারের গাফিলতির কারণে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

স্থানীয়রা বলছেন, এখানে পর্যটকদের নিরাপত্তা, যাতায়াত, গাইড ও অবকাঠামোগত কোনো সুবিধা নেই। দুর্ঘটনা ঘটলে বন বিভাগ এবং ইজারাদার কেউ দায়িত্ব নেয় না। ঝরনাগুলো ইজারা দিয়ে পর্যটকদের মৃত্যুকূপে ফেলে দেওয়ার মতো অমানবিক দায়িত্ব পালন করছে বন বিভাগ।

যোগাযোগ করা হলে নাপিত্তাছড়া ঝরনার ইজারাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স টিএসআর ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী আনিসুর রহমান আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, চলতি বছরের ২৯ এপ্রিল ২৭ লাখ ৮১ হাজার টাকায় খৈয়াছড়া, নাপিত্তাছড়া, রূপসি, সহস্রধারা ঝরনা ও বাওয়াছড়া লেক বন বিভাগ থেকে ইজারা নিয়েছি।

তিনি বলেন, সম্প্রতি যে তিন ছাত্র মারা গেছেন, এই তিন ছাত্র টিকিট কেটে ঝরনায় পবেশ করেছেন। সরকারিভাবে ঝরনায় নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেই।

আরও পড়ুন: মিলল তারেকের লাশ, ৩ মৃত্যুর জন্য কাঠগড়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান

এদিকে পর্যটকদের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো গাইড রাখা হয়েছে কি-না জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেননি। তবে সচেতনতায় কিছু প্লেকার্ড লাগিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

এদিকে ঝরানাগুলো ইজারা দিয়ে বছরের পর বছর লাখ লাখ টাকা আয় করছে বন বিভাগ। তবে উপজেলা প্রশাসন বলছে, বিষয়টি নিয়ে আমরা মিটিং করব। ইজারা বাতিল করে ঝরনাগুলো উপজেলা পরিষদের আওতায় আনা হবে। এ নিয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে।

খৈয়াছড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাহফুজুল হক জুনু বলেন, পর্যটকদের অসতর্কতা এবং বন বিভাগ ও ইজারাদারের দায়িত্বহীনতার কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটে।

মিরসরাই থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কবির হোসেন বলেন, মিরসরাই উপজেলার ঝরনাগুলোতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দল বেঁধে পর্যটকরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন। এসব ঝরনা পর্যটক যাওয়ার মতো যাতায়াত, নিরাপত্তা এবং কোনোরকম অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা নেই। প্রাকৃতিক এ ঝরনাগুলো বন বিভাগ কোনো কাজ না করেও বছর বছর ইজারা দিয়ে থাকে।

যোগাযোগ করা হলে মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিনহাজুর রহমান আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, আমরা মিটিং করে ঝরনাগুলোর ইজারা বাদ দিয়ে উপজেলা প্রশাসনের আওতায় নিয়ে আসব। এছাড়া ঝরনায় তিনজনের মৃত্যুর ঘটনায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক বরাবর একটি চিঠি দিয়েছি।

জানা যায়, রোববার (১৯ জুন) মিরসরাইয়ের নাপিত্তার ছড়া ঝরনায় ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি চট্টগ্রামের (ইউএসটিসি) স্নাতকের ছাত্র মাসুদ আহম্মেদ তানভীর, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল এন্ড কলেজের মেধাবী ছাত্র তৌফিক আহম্মেদ তারেক ও চট্টগ্রাম ইস্পাহানী পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের মেধাবী ছাত্র ইশতিয়াকুর রহমান প্রান্তের করুণ মৃত্যু হয়।

আরও পড়ুন: নাপিত্তাছড়া ঝরনায় নয়, বন্ধুর লাশ মিলল খালে—এখনো নিখোঁজ ভাই

২০১৯ সালের ২ এপ্রিল খৈয়াছড়া ঝরনার ওপর থেকে পা পিছলে পড়ে মো. আশরাফ হোসেন (৩০) নামে এক যুবক নিহত হন। ২৮ জুন খৈয়াছড়া ঝরনায় আনোয়ার হোসেন নামে এক পর্যটক ওপর থেকে পড়ে নিহত হন। ১২ জুলাই বোয়ালিয়া ঝরনা দেখতে আসা ১৫ ছাত্রছাত্রী অসতর্কতার জন্য ঝরনার পথে ছরায় পানি বেড়ে যাওয়ায় আটকা পড়েন। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গিয়ে তাদের উদ্ধার করেন।

১৭ জুলাই মহামায়া লেকের পানিতে ডুবে মারা যান শাহাদাত হোসেন (২২)। ২৬ জুলাই অসতর্কভাবে ছবি তুলতে গিয়ে খৈয়াছড়া ঝরনায় আবু আলী আল হোসাই মেমোরী (৩০) নামে এক প্রকৌশলীর মৃত্যু হয়। ১৫ আগস্ট চট্টগ্রাম থেকে আসা মেহেদী হাসান (২২) নামে প্রকৌশলের এক ছাত্রের রুপসী ঝরনায় করুণ মৃত্যু হয়। ২৯ আগস্ট দেলোয়ার হোসেন নামে চট্টগ্রামের এক পুলিশ কর্মকর্তা আহত হন। ৪ সেপ্টেম্বর ফেনী থেকে আসা ফয়েজ আহমদ নামে এক পর্যটক পা পিছলে পড়ে মারা যান। আহত হন কমপক্ষে ৪ জন।

২০১৮ সালে ১৫ আগস্ট নাপিত্তাছড়া ঝরনায় ডুবে অনিমেষ দে (২৭) নামে এক পর্যটকের মৃত্যু হয়। ২৪ আগস্ট বড়কমলদহ রূপসী ঝরনার ওপর থেকে পড়ে গিয়ে মারা যান সাইফুল ইসলাম নামে এক যুবক। ১৫ জুলাই খৈয়াছড়া ঝরনার পঞ্চম স্তরে ওঠার পর স্থানীয় এক পর্যটক পা পিছলে পড়ে যাওয়ার সময় তাকে ধরতে যান ওয়াসিম আসগর নামে অপর এক পর্যটক। ওই পর্যটক সামান্য আঘাত পেলেও ওয়াসিম পাহাড়ের নিচে পড়ে যায়। এতে মারাত্মকভাবে আহত হন তিনি।

আরও পড়ুন: ঝরনা থেকে পড়ে লাশ যুবক, সঙ্গীরা কোথায় কেউ জানে না

২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর নাপিত্তাছড়া ঝরনায় সাঁতার কাটার সময় চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ শিক্ষার্থী শাহাদাত হোসেন মামুনের (২২) মৃত্যু হয়। এছাড়া আরো এক পর্যটক মিরসরাইয়ের ঝরনায় ঘুরতে এসে মারা যান, তার পরিচয় পাওয়া যায়নি।

এসব দুর্ঘটনার জন্য অনেকেই কোনো কাজ না করেও বন বিভাগের দায়িত্বহীন ইজারা বাণিজ্য এবং ইজারাদারদের দায়ী করেছেন।

এসআই/আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!