৯ বছর পর বাবাকে দেখে কেঁদে উঠে সেই পপি, চোখের জলে বিদায় সাতকানিয়া

খুঁজে পাওয়ার পথ দেখাল দৈনিক  আলোকিত চট্টগ্রাম

শঙ্খ নদীর তীরে পাহাড়-সবুজে ঘেরা সুন্দর এক গ্রাম শীলঘাটা। এই গ্রামে গত এক বছর ধরে বিভিন্ন বাড়ির আঙিনা বা রাস্তার ধারে ভবঘুরে দিন কাটিয়ে আসা মানসিক ভারসাম্যহীন সেই পপিকে বাড়ি নিয়ে যেতে ব্রাম্মণবাড়িয়ার কসবা থেকে তার পরিবারের লোকজন এসেছে। এ উপলক্ষে গ্রামের মুসলিমপাড়া এলাকার একটি বাড়িকে ঘিরে কৌতূহল আর আনন্দমুখর পরিস্থিতি বিরাজ করছিল স্থানীয়দের মধ্যে। অবশেষে এলো সেই মহেন্দ্রক্ষণ, ৯ বছর পর দেখা হলো বাবা-মেয়ের। কাঁদলেন তারা, কাঁদালেন অনেককেই, এই কান্না মিলনের, এই কান্না আনন্দের।

রোববার (৩ সেপ্টেম্বর) সাতকানিয়া উপজেলার পুরাণগড় ইউনিয়নের শীলঘাটা মুসলিমপাড়া এলাকার জাশেদুল ইসলামের বাড়িতে এমনই আবেগঘন পরিবেশের দেখা মিলে।

এর আগে গত শুক্রবার (১ সেপ্টেম্বর) দৈনিক আলোকিত চট্টগ্রামে ‘রাস্তার ধারে কাটে দিনরাত, পরিবারের কেউ খোঁজ নেয় না কসবার পপির’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনে গত এক বছর ধরে শীলঘাটা এলাকায় দিন পার করে আসা মানসিক ভারসাম্যহীন পপির গল্প তুলে ধরা হয়। সংবাদ প্রকাশের পর পপির অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারে তার পরিবার। এরপর পপির পরিবার ছুটে আসে পপিকে বাড়ি নিয়ে যেতে। দীর্ঘ ৯ বছর পর পপি ফিরে পান তার পরিবার।

এদিকে রোববার (৩ সেপ্টেম্বর) শীলঘাটা মুসলিমপাড়ার জাশেদুল ইসলাম নুনুর বাড়িতে পপিকে নিতে আসেন তার বাবা তাজুল ইসলাম ও ভাই মইনুদ্দিন।

দীর্ঘ ৯ বছর পর পপিকে ফিরে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা ও ভাই। বহুদিন পর বাবা-ভাইকে দেখে মানসিক ভারসাম্যহীন পপির কান্নায় ছুঁয়ে যায় উপস্থিত সবাইকে। পপির সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যদের মিলনের দৃশ্য দেখতে জাশেদুল ইসলামের বাড়িতে জমায়েত হয়েছিলেন স্থানীয় অসংখ্য মানুষ। বিশেষ করে এলাকার বিভিন্ন বাড়ির মহিলা ও বাচ্চাদের সঙ্গে গত এক বছরে পপির তৈরি হয়েছিল এক ধরনের সখ্যতা। এই এলাকায় পপির বিদায়ী দিনে এসব মহিলা ও বাচ্চারা ছুটে এসেছেন পপি ও তার পরিবারের সদস্যদের মিলন দেখতে। এই সময় অনেকেই শোনালেন  গ্রামে গত এক বছর ধরে পপির পদচারণার গল্প, নানান স্মৃতির কথা।

শীলঘাটা মুসলিম পাড়ার গৃহিণী মনোয়ারা বেগম আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, ‘পপি বিভিন্ন সময় আমাদের বাড়িতে আসতো। অনেকদিন থাকতো, আবার মন ছুটলে অন্য কোথাও চলে যেতো, আবার ফিরে আসতো। যেহেতু মানসিক সমস্যার কারণে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এখানে এসেছে, তাই আমি তাকে আমাদের পরিবারের একজন সদস্যের মতো দেখতাম। নিজের মেয়ের মতো করে আদর করতাম, খেতে দিতাম। সে আমাকে বাড়ির টুকটাক কাজেও সহায়তা করতো। তবে আমি মনে মনে চাইতাম পপিকে যেন তার পরিবার ফিরে পায়। এখন তাকে নিয়ে যেতে তার পরিবারের লোকজন এসেছেন। এটা দেখে আমার খুবই আনন্দ লাগছে।’

পপি শীলঘাটা গ্রামে আসার পর গত এক বছরে অধিকাংশ সময় কাটিয়েছে মুসলিম পাড়া এলাকার জাশেদুল ইসলাম নুনু ও জেসমিন আক্তার গিন্নীর ঘরের আঙিনায়। পপির সঙ্গে বাবা-ভাইয়ের মিলনও হলো এই দম্পতির বাড়িতে।

জাশেদুল ইসলাম নুনু আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, আজ এই গ্রামে পপির শেষ দিন, পপি বাবা-ভাইয়ের সঙ্গে ফিরে যাচ্ছে তার বাড়িতে। পপিকে খুব মিস করবো। তাকে নিজের বোনের মতো দেখতাম। এক বছর আগে মানসিক ভারসাম্যহীন পপিকে এই গ্রামের একটি দোকানের আঙিনায় বসে থাকতে দেখে আমার বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম। আমার স্ত্রী পপিকে আদর-যত্ন করে, পপিও আমার স্ত্রীকে গৃহস্থলি ঠুকিঠাকি কাজে সহায়তা করতো। টানা অনেকদিন ছিল আমার বাড়িতে। তবে মানসিক সমস্যার কারণে সে এক জায়গায় স্থির থাকতো না, একেক সময় একেক বাড়িতে যেত। এই গ্রামের প্রায় সকল বাড়িতেই পপিকে আদর করতো, খেতে দিত। অবশেষে পপি তার বাবা-মায়ের বুকে ফিরে যাচ্ছে, তা দেখে আমার ভীষণ ভালো লাগছে।’

জাশেদুল ইসলাম নুনুর বাড়িতে পপি ও তার বাবা-ভাইয়ের মিলনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে উপস্থিত ছিলেন সাতকানিয়ার পুরাণগড় ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মমতাজ উদ্দিন। তিনি আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, ‘পপি গত এক বছর আগে আমার ১ নম্বর ওয়ার্ডে আসে। সেই থেকে তাকে এই এলাকার মানুষজন পপি নামেই চিনে। আজ পপির বাবা-ভাই এসেছেন তাকে নিয়ে যেতে। তাকে তার পরিবারের কাছে তুলে দিতে জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমি উপস্থিত হয়েছি। সাতকানিয়া থানা থেকে পুলিশের একটা টিমও এসেছেন। পপি তার পরিবারের কাছে ফিরে যাচ্ছে, তাই আমিসহ আমার এলাকার মানুষজন অত্যন্ত খুশি হয়েছেন।’

পপিকে তার বাবা-ভাইয়ের কাছে হস্তান্তরের সময় এসআই আবু বক্করের নেতৃত্বে সাতকানিয়া থানা পুলিশের একটি টিম উপস্থিত ছিলেন। এই সময় আবু বক্কর বলেন, ‘একটা মানসিক ভারসাম্যহীন অসহায় মেয়ে ৯ বছর পর তার বাবা-মার কাছে ফিরে যাচ্ছে, এটা অত্যন্ত আনন্দের। তাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য প্রতিবেদকের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। প্রতিবেদনটির কারণে এই মেয়ের পরিবার এতদিন পর তার খোঁজে পেল। এছাড়া গত এক বছর ধরে বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার জন্য শীলঘাটা গ্রামের বাসিন্দাদেরও ধন্যবাদ জানাই।’

পপির বাবা তাজুল ইসলাম আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, ‘পপির বিয়ের পর একটা ছেলে সন্তানের মা হন। সন্তান হওয়ার ৪-৫ মাসের মধ্যে পপির মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। এরপর তার স্বামী তাকে ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করে। পপিকে বাড়ি নিয়ে এসে তার সন্তানসহ আমরা লালন-পালন করে আসছিলাম। এর মধ্যে প্রায় ৯ বছর আগে পপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। এই সময় তার ছেলে পারভেজের বয়স ছিল পাঁচ বছর। এত বছর ধরে বিভিন্ন জায়গায় পপিকে অনেক খুঁজেছি, কিন্তু কোথাও পেলাম না। তবে আশা ছিল একদিন মেয়েকে ঠিকই খুঁজে পাবো। এর মধ্যে পপির ছেলে পারভেজ ১৫ বছরের কিশোরে পরিণত হয়। মাকে ছাড়াই পারভেজ ৯ বছর কাটিয়ে ফেলেছে। এখন সে ঢাকায় তার এক খালার বাসায় থেকে নবম শ্রেণিতে পড়ছে।’

তিনি বলেন, ‘গত শুক্রবার দৈনিক আলোকিত চট্টগ্রামে পপিকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলে দীর্ঘ ৯ বছর পর পপির অবস্থান সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। সংবাদ প্রকাশসহ পপিকে ফিরে পেতে সার্বিকভাবে আমাদেরকে সহযোগিতা করার জন্য আমরা দৈনিক আলোকিত চট্টগ্রামের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এছাড়া আমার মেয়েকে গত এক বছর ধরে বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় ও আদর-যত্ন করার জন্য শীলঘাটা মুসলিম পাড়ার সকল বাসিন্দাদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’

এদিকে পপিকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশসহ তাকে ফিরে পেতে সার্বিক সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশে পপিকে নিয়ে দৈনিক আলোকিত চট্টগ্রাম অফিসে আসেন পপির বাবা তাজুল ইসলাম ও ভাই মইনুদ্দিন।

এ সময় তারা দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিন উপদেষ্টা সম্পাদক ও আলোকিত চট্টগ্রামের সম্পাদক আয়ান শর্মার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেন।

উপস্থিত ছিলেন দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ আকবরী।

এই সময় পপির হাতে উপহার হিসেবে শাড়ি তুলে দেন আলোকিত চট্টগ্রামের প্রতিবেদক প্রণয় দাশ সানী।

এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে বাড়ি ফেরার জন্য পপি ও তার পরিবারের সদস্যদের জন্য ট্রেনের একটি চারজনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বার্থ উপহার দেন রেলওয়ে শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম।

আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!