ঝালমুড়ি বিক্রেতা থেকে চট্টগ্রামের ‘গডফাদার’ সোনা আবু, পালাল বিদেশে

ছিলেন ঝালমুড়ি বিক্রেতা। এরপর আরব আমিরাত প্রবাসী। সেখানেই জড়িয়ে পড়ের হুন্ডি, সোনা চোরাচালানসহ বিভিন্ন অবৈধ বাণিজ্যে। পরে দেশে বিস্তৃত করেন অবৈধ এসব বাণিজ্যের জাল। চোরাচালান ও হুন্ডির সাম্রাজ্যে তিনি বনে যান ‘গডফাদার’।

গত একদশকে সোনা চোরাচালান করতে করতে তাঁর নাম রটে গেছে ‘সোনা আবু’। অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে গড়েছেন হাজার কোটি টাকার সম্পদ। পুলিশের অপরাধ তদন্তকারী সংস্থার (সিআইডি) অনুসন্ধানে অর্থ পাচারেরও প্রমাণ মিলে তাঁর বিরুদ্ধে।

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ফতেপুর গ্রামের ফয়েজ আহমেদ ওরফে বলি সওদাগরের ছেলে আবু আহমদ ওরফে আবু দেশের চোরাচালান সাম্রাজ্যে রীতিমতো কিংবদন্তী।

তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হলেও বেশ কয়েক বছর পর গ্রেপ্তার হন আবু। তবে জেলে বেশিদিন থাকতে হয়নি তাঁকে। আইনজীবীর সহায়তায় জামিনে বেরিয়ে দেশ ছেড়ে পালান তিনি। তবে দেশে না থাকলেও আবুর চোরাচালান সাম্রাজ্য রয়েছে আগের মতোই।

এদিকে আদালতের নিষেধাজ্ঞার পরও আবু কীভাবে বিদেশ পালিয়ে গেলেন সেই বিষয়ে কোনো আলোচনা না থাকলেও হাইকোর্টের দেওয়া জামিন স্থগিত রেখে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ।

সোমবার (১০ জুলাই) প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ এ আদেশ দেন। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারওয়ার হোসেন বাপ্পী।

জানা গেছে, ২৪০ কোটি ৫ লাখ ১২ হাজার ১৬০ টাকা পাচারের অভিযোগে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় ২০২০ সালের ১৮ মার্চ মামলা হয় আবুর বিরুদ্ধে। এ মামলায় ২০ জনকে আসামি করেন সিআইডির উপপুলিশ পরিদর্শক মো. হারুন উর রশীদ। কিন্তু আইনজীবীর মাধ্যমে দুবছর পর আগাম জামিন চান আবু। সেই আবেদনে ২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি আবুকে তিন সপ্তাহের মধ্যে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ।

বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের সেই বেঞ্চ আদালতের অনুমতি ছাড়া তাঁর বিদেশযাত্রায়ও নিষেধাজ্ঞা দেন।

কিন্তু অসুস্থতা ও নানা বাহানায় বারবার সময়ের আবেদন করতে থাকেন আবু। পরে একই বছরের ১৩ নভেম্বর চট্টগ্রাম সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আজিজ আহমেদ ভূঁঞার আদালত তাঁর জামিন বাতিল করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৫ ডিসেম্বর হাইকোর্টে জামিন আবেদন করলে পরদিন ৬ ডিসেম্বর আবুর বিদেশযাত্রায়ও আসে নিষেধাজ্ঞা।

আরও পড়ুন: কক্সবাজারে ফিল্মি স্টাইলে ছিনতাই—৪ জন ধরা খেলেও পালের গোদা অধরা

চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি হাজিরার পর সোনা আবুকে শাহবাগ থানা পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। পরে চট্টগ্রামের একটি আদালতে হাজির করা হলে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর তিনি হাইকোর্টে জামিন চেয়ে আবেদন করেন। গত ৬ এপ্রিল তাঁকে জামিন দিয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করেন।

এদিকে এই জামিন স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করেন। ১১ এপ্রিল তাঁর জামিন স্থগিত করেন চেম্বার আদালত। একইসঙ্গে নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠান। এতে ৮ মে পর্যন্ত জামিন স্থগিত করা হয়। পরে ২৯ মে আপিল বিভাগের শুনানিতে আবুর আইনজীবী আদালতকে জানান, আসামি হেফাজতের বাইরে। আবুর দেশ ত্যাগ করার বিষয়টি আদালতকে জানান। সেদিন শুনানি শেষে আবুকে ১২ জুনের মধ্যে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেন আদালত। কিন্তু আত্মসমর্পণ না করায় ১০ জুলাই জামিন স্থগিত রেখে তাঁকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেন আদালত।

সূত্র বলছে, আবু এখন দেশেই নেই। তিনি অনেকদিন ধরেই অবস্থান করছেন দুবাইয়ে। সেখান থেকেই নাড়ছেন দেশে চোরাচালান ও হুন্ডি ব্যবসার কলকাঠি।

আরেকটি সূত্র বলছে, আবু দেশেই আছেন প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায়। তাকে রক্ষা করতে ঢাকা-চট্টগ্রামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ, সাংসদ এমনকি ব্যবসায়ী নেতাকেও বিভিন্ন সময় তৎপর হতে দেখা গেছে। তাদের কারও কারও রোষে পড়তে হয়েছে খোদ তদন্তকারী সংস্থাকে।

জানা গেছে, হুন্ডি ব্যবসা ও সোনা চোরাচালানের অন্যতম গডফাদার চট্টগ্রামের আবু আহমেদের ৭২১ কোটি ১৭ লাখ টাকার সম্পদের খোঁজ পায় সিআইডি। সিআইডি ফিনান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট এ নিয়ে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে আদালতে। সোনা চোরাচালান মামলায় অভিযুক্ত আবু আহমেদের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করে সিআইডির ফিনান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট তাঁর অবৈধ অর্থের খোঁজ পায়। এ চক্রের সঙ্গে জড়িত ২১ জনকে অভিযুক্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয় সিআইডি।

সিআইডি জানায়, মূলহোতা আবু আহমেদ চট্টগ্রামে অর্থপাচার এবং সোনা ও অন্যান্য পণ্য চোরাচালানের মাধ্যমে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছে। তার সম্পদের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি ভবন, প্লট, বিলাসবহুল বাড়ি। দুবাইতেও তার তিনটি দোকান রয়েছে।

ফরহাদ ট্রেডিং, রিয়াল ট্রেডিং, নাইস টেলিকম সেন্টার, রূপা টেলিকমিউনিকেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ২১টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেন আবু আহমেদ। এসব ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লেনদেন হয়েছে বিপুল পরিমাণ টাকা।

তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের টাকা নিয়ে তিনি হুন্ডি ব্যবসা করেন। এছাড়া সোনা চোরাচালান করতে করতে তিনি পরিচিতি পান ‘সোনা আবু’ বা ‘গোল্ডেন আবু’ নামে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে খোঁজ মিলেছে তার নামে কেনা ২৪টি জমির। সেই সঙ্গে চট্টগ্রাম নগরেই আছে তাঁর বিলাসবহুল তিনটি বাড়ি!

আড়ালের গডফাদার

১৯৯১ সালে শ্রমিক ভিসা নিয়ে দুবাই যান আবু। এর কয়েক বছর পর আবার দেশে ফিরে আসেন। সেই থেকে তিনি আছেন আরব আমিরাত আর বাংলাদেশে আসা-যাওয়ার মধ্যেই। সোনা চোরাচালান ও হুন্ডির ব্যবসায় তাঁকে ‘গডফাদার’ হিসেবে মানা হয়। একদশক আগে স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িয়ে পড়া আবু হুন্ডিসহ চোরাই মালের ব্যবসায়ও করিৎকর্মা।

২০১৩ সালের ৩ আগস্ট নগরের হিলভিউ আবাসিক এলাকার বাসার সামনে থেকে অপহরণ করা হয় আবুকে। তখনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে উঠে আসে আবু নামে রহস্যময় বিত্তশালীর নাম। একদশক আগের সেই অপহরণের ঘটনায় কোটি টাকা মুক্তিপণে ছাড়া পান অজ্ঞাত দুর্বৃত্তের হাত থেকে।

পরে ঘটনার পাঁচ মাস পর ২০১৪ সালের ২২ জানুয়ারি পাঁচলাইশ থানায় মামলা দায়েরের পর অপহরণের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তবে সোনা চোরাচালানের গডফাদার হিসেবে আবুর নাম প্রথম আলোচনায় আসে ২০১৪ সালে। ওই বছর ঢাকায় চোরাচালানের সোনা উদ্ধারের পরপর তিনটি ঘটনায় দৃশ্যপটে আসেন আবু। এর মধ্যে ১০৫ কেজি ওজনের ৯০৪ পিস সোনার প্রথম চালান ধরা পড়ে রাজধানীর শাহজালাল বিমানবন্দরে।

পরে একই বিমানবন্দরে ৫২৫ পিস সোনার বারসহ ধরা পড়ে বিপুল পরিমাণ সৌদি মুদ্রার অপর একটি চালান। ৬১ কেজি সোনার আরেকটি চালান ধরা পড়ে ঢাকার নয়াপল্টন থেকে। এসব ঘটনায় ঢাকা বিমানবন্দর থানা ও পল্টন থানায় আবুর বিরুদ্ধে মামলা হয়।

এরপর ২০১৬ সালের ২৫ জানুয়ারি নগরের রিয়াজউদ্দিন বাজারের বাহার মার্কেট থেকে তৎকালীন নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার বাবুল আক্তারের নেতৃত্বে উদ্ধার করা হয় তিন সিন্ধুকভর্তি বিপুল পরিমাণ সোনা ও নগদ টাকা। এর মধ্যে একটি সিন্দুক থেকে ২৫০টি সোনার বার এবং অন্য এক সিন্ধুকে পাওয়া যায় নগদ ৬০ লাখ টাকা। এ ঘটনায় আবু ও তাঁর ম্যানেজার এনামুল হক নাঈমকে আসামি করে কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়।

ওই মামলায় আবুকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু নাটকীয় কায়দায় তিনি মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় চট্টগ্রাম কারাগার থেকে বের হয়ে যান। সেই থেকে তিনি রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

কারাগার ছাড়েন জোচ্চুরিতে

জানা গেছে, গ্রেপ্তার হওয়ার পর ২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট থেকে ৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে হাইকোর্টের দুই বিচারপতির স্বাক্ষর জাল করে স্বর্ণ চোরাচালান মামলার কার্যক্রম স্থগিতের বিষয়ে একটি পিটিশন তৈরি করান আবু। ২০১৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের ফৌজদারি মিস শাখার মাধ্যমে সেই পিটিশনটি বিচারিক আদালতে পাঠানো হয়। ভুয়া স্থগিতাদেশ তৈরি করে তথ্য গোপনের মাধ্যমে জামিন নিয়ে ওই বছরের আগস্টে তিনি কারাগার থেকে বের হয়ে যান।

এসআই/আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!