শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ‘টপ—টেন’ গ্যাং লিডার

চট্টগ্রাম শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ‘টপ টেন’ গ্যাং লিডার। পুরো নগরকে আয়ত্বে রাখতে মরিয়া তারা। নিচ্ছেন নিত্যনতুন কৌশল। এলাকায় এদের অনেকই পরিচিত ‘কিশোর গ্যাং লিডার’ কিংবা ‘বড় ভাই’ হিসেবে।

এসব ভয়ঙ্কর গ্যাং লিডারের কারো কারো নামে রয়েছে খুন, চাঁদাবাজিসহ ডজনেরও বেশি মামলা। এদের মধ্যে অনেকে আছেন কারাগারে। আবার কেউ বেরিয়েছেন জামিনে। তবে কারাগারে থাকুক, কিংবা মুক্ত হাওয়ায়—সবখানেই তাদের সমান দাপট।

এই গ্যাং লিডাররা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বেশ সক্রিয়। দাপুটে নেতাদের সঙ্গে ছবি দিয়ে জানান দেন নিজের ক্ষমতার। কোন নেতার সঙ্গে কার বেশি সখ্যতা তা নিয়েও চলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

গত কয়েক বছরের অপরাধ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ন্যূনতম ১০ কিশোর গ্যাং ভয়ঙ্কর অপরাধে সক্রিয়। মামলা, গ্রেফতার কোনোকিছুতেই তারা দমছে না। রাজধানী ঢাকায় কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান হলেও, চট্টগ্রামে তেমন আশানুরূপ সাফল্য নেই। ফলে চট্টগ্রাম শহরে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এসব কিশোর গ্যাং সদস্যরা।

এদের বিরুদ্ধে এলাকার কেউ ভয়ে মুখ খুলতে পারে না। খুললেই মামলা-হামলার শিকার হতে হয়।

জানা যায়, চট্টগ্রামে ২০১৮ সালে স্কুলছাত্র আদনান ইসফার হত্যাকাণ্ডের পর নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ওইসময় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) নগরের ১৬ থানায় কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা প্রস্তুত করে। এতে উঠে আসে ৪৮ জন গডফাদারের নাম। যাদের বেশিরভাগই সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে অপরাধের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন। সেই তালিকার তিনজন চসিকের কাউন্সিলরের দায়িত্বে রয়েছেন।

চট্টগ্রাম শহরে এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ১০ ভয়ঙ্কর গ্যাং লিডার। নগরের বিভিন্ন স্থানে তারা গড়ে তুলেছেন নিজেদের সাম্রাজ্য।

ফ্রুট সোহেল

নগরের অপরাধপ্রবণ এলাকার শীর্ষে থাকা চান্দগাঁও থানাধীন বহদ্দারহাট এলাকায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সোহেল ওরফে ফ্রুট সোহেল। কিশোর জিয়াদ ও হক মার্কেটের সিকিউরিটি গার্ড সবুর হত্যাকাণ্ডের আসামিরা সবাই সোহেলের সহযোগী। চাঁদার জন্য আমজাদ নামে এক ব্যক্তির দুই পা ছিদ্র করে দেয় তারা। গত ১ এপ্রিল এই গ্রুপের সদস্যরা বিচ্ছিন্ন করে দেয় বারইপাড়ায় আনোয়ার নামে এক গার্মেন্টস কর্মকর্তার হাতের কব্জ। ফ্রুট সোহেলের প্রধান দুই সহযোগী হলেন ছয় মামলার আসামি ধামা জুয়েল ও দুই মামলার আসামি রুবেল। অবশ্য সোমবার (৫ জুলাই) র‌্যাবের জালে ধরা পড়ে রুবেল।

কিলার ফয়সাল

২০১৮ সালের ২৭ এপ্রিল নগরের ডিসি রোডে ক্যাবল ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফয়সালের গুলিতে মারা যায় ফরিদুল ইসলাম নামে আরেক সন্ত্রাসী। ২০১৪ সালে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইমনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেছিল। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর বায়েজিদে শ্রমিক নেতা রিপন হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামিও তিনি৷ তাঁর বিরুদ্ধে অন্তত ১৮টি মামলা রয়েছে। নগরের বাকলিয়া ও চকবাজার থানা এলাকায় বেপরোয়া সন্ত্রাসী কার্যকলাপে সক্রিয় রয়েছে তাঁর গ্রুপ।

শেখ মহিউদ্দিন

বাকলিয়া থানাধীন বলিহারহাটে সম্প্রতি কবরস্থানের বিরোধ নিয়ে এয়াকুব বাহিনীর গুলিতে অন্তত ৪ জন গুলিবিদ্ধসহ ১৫জন আহত হন। চলতি বছর কলেজছাত্র রোহিত ছুরিকাঘাতে মারা যান। রোহিত হত্যাকাণ্ডের আসামি শেখ মহিউদ্দিনের রয়েছে ভয়ঙ্কর গ্যাং। এ মামলায় আটকের পর ইতোমধ্যে তিনি জামিনে বেরিয়ে এসেছেন। এর আগে র‍্যাবের হাতে অস্ত্রসহ আটক হয়েছিলেন। চকবাজার থানার বগারবিলে রয়েছে সোহেল রানা ওরফে সেলু এবং রসুলবাগের তামিমের কিশোর গ্যাং। তবে তাঁরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে।

সাদ্দাম হোসেন ইভান

চকবাজার থানা পুলিশের কিশোর গ্যাং তালিকায় এক নম্বরে নাম রয়েছে চার মামলার আসামি ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দাম হোসেন ইভানের। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসকের উপর বহিরাগত সন্ত্রাসী হামলার মামলায়ও আসামি ইভান। তাঁর অন্যতম সহযোগী নাইমুল হাসান ওরফে ভাঙারি তুষার। ইভান এলাকায় পরিচিত চকবাজারের কথিত যুবলীগ নেতা নুর মোস্তফা টিনুর সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে।

দাঁতলা সুমন

আগ্রাবাদ বাণিজ্য এলাকার ত্রাস হিসেবে পরিচিত সুমন ওরফে দাঁতলা সুমন। তিনি পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। তাঁর বিরুদ্ধে ডবলমুরিং থানায় মামলা সংখ্যা ১৫টি। ২০১৯ সালে ঈদের দিন বাসা থেকে ডেকে নিয়ে সোহেল নামে এক শিক্ষার্থীকে কুপিয়ে হত্যা করেছিল সুমনের গ্রুপ। অস্ত্রহাতে ছবিসহ সংবাদের শিরোনামও হয়েছেন বেশ কয়েকবার। দাঁতলা সুমন আগ্রাবাদের গণপূর্ত অফিসের টেন্ডার নিয়ন্ত্রক এবং সন্ত্রাসী এসএম পারভেজের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে পরিচিত।

সোলেমান বাদশা

পাঁচলাইশ থানার ২ নম্বর গেইট এলাকার ত্রাস সোলেমান বাদশা। ২০১৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ২ নম্বর গেইট এলাকার  চেকপোস্টে পাঁচলাইশ থানার এএসআই আব্দুল মালেক পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। গুলি করেছিল খোকন নামে এক কিশোর। তাদের অস্ত্র সরবরাহ করেন সোলেমান বাদশা। কিছুদিন আগেও ঠিকাদারের কাছে চাঁদাবাজির ঘটনায় আটক হয়েছিলেন তিনি। প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাসিম আহমেদ সোহেল হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি এই বাদশা।

ডাকাত ফিরোজ

২০১৮ সালের এপ্রিলে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা স্কুলছাত্রী তাসফিয়া আমিন হত্যা মামলার মধ্যদিয়ে উঠে আসে ‘রিচ কিডস’ নামে একটি কিশোর গ্যাং। মামলার প্রধান অভিযুক্ত আদনান মির্জা গ্রুপটির নেতৃত্বে ছিলেন। তাদের বড় ভাই ছিলেন পাঁচলাইশ এলাকার মো. ফিরোজ ওরফে ডাকাত ফিরোজ। গতবছর চাঁদার জন্য এক প্রবাসীর ভবনে পেট্রোল বোমা হামলা চালায় ওই গ্রুপটি। এ পর্যন্ত অস্ত্রসহ তিনবার আটক হন ফিরোজ। তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে হত্যাসহ এক ডজন মামলা।

লম্বা নাছির

কালারপুল ও চান্দঁগাও খতিবেরহাট এলাকার কিশোর গ্যাং লিডার নাছির উদ্দিন ওরফে লম্বা নাছির। ২০১৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর ফরিদেরপাড়া এলাকায় দিনদুপুরে প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় নুরুল আলম নামের এক যুবককে। এ ঘটনায় জড়িতরা সবাই ছিল নাছিরের গ্যাংয়ের সদস্য। এতে নেতৃত্ব দেয় ইমন ও আমজাদ নামে দুই কিশোর। লম্বা নাছির চকবাজারের কিশোর গ্যাং লিডার নুর মোস্তফা টিনুর অনুসারী।

কালা জুয়েল

কোতোয়ালি মোড় ও নিউমার্কেট এলাকার ত্রাস দশ মামলার আসামি আলকরণের শাহেদুল আলম ওরফে কালা জুয়েল। সম্প্রতি তার গ্রুপের তিন সদস্যকে দেশীয় অস্ত্রসহ আটক করেছে পুলিশ। এর আগে অভয়মিত্র ঘাটে এক কিশোরকে এলোপাতাড়ি কোপায় কালা জুয়েল। এসময় দুই রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়ে। সেই অস্ত্রটি এখনো উদ্ধার করা যায়নি।

ডাবু ফয়সাল

বিগত এক দশকে আধিপত্যের লড়াইয়ে সর্বোচ্চ খুনোখুনি হয়েছে সদরঘাট থানা এলাকায়। এখানে ভয়ঙ্কর গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন  ছাত্রলীগ নামধারী মোশাররফ হোসেন ওরফে ডাবু ফয়সাল। আইস ফ্যাক্টরি রোড়ে মুজিব নগর ক্লাবের নামে তিনি গড়ে তুলেছেন বিশাল আখড়া। সেখান থেকেই মূলত নিয়ন্ত্রণ হয় ডাবু ফয়সাল গ্রুপের সব অবৈধ কর্মকাণ্ড। ডাবু ফয়সালের বিরুদ্ধে রয়েছে তিনটি মামলা। একটি মামলায় দুই মাস কারাভোগও করেছেন তিনি।

আরবি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!