সিন্ডিকেটের কবলে চট্টগ্রামে ২ ট্রেনের যাত্রীরা, ‘জিম্মি’ করে প্রতিদিন লাখ টাকার বাণিজ্য

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা ও ময়মনসিংহগামী দুটি ট্রেন ঘিরে চলছে সিট বাণিজ্য। এ দুটি ট্রেনের টিকিটে সিট ও বগি উল্লেখ না থাকার ফায়দা লুটছে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী, রেলওয়ে পুলিশ, বহিরাগত দুষ্কৃতিকারীসহ গড়ে উঠা সিন্ডিকেট। এ নিয়ে প্রায়সময় যাত্রীদের সঙ্গে তর্ক ও মারামারির ঘটনা ঘটলেও নেওয়া হয় না কার্যকর পদক্ষেপ। সম্প্রতি এক সেনা সদস্যকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় বিষয়টি আবারও আলোচনায় উঠে আসে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম থেকে প্রতিদিন একটি মেইল ট্রেন রাত সাড়ে ১০টায় ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ট্রেনের টিকিটে সিট ও বগির বিষয়টি উল্লেখ থাকে না। আর এর পূর্ণ ফায়দা নেয় কতিপয় অসাধু আরএনবি সদস্য, রেলওয়ে পুলিশ সদস্য, বুকিং সহকারী, ফিম্যান, পিএসএম (প্লাটফর্ম স্টেশন মাস্টার) ও বহিরাগত সমন্বয়ে গড়ে উঠা সিন্ডিকেট। অসাধু আরএবি ও রেলওয়ে পুলিশ সদস্যরা ট্রেন ছাড়ার আগে ৫-৬টি বগি দখল করেন। এরপর বগির দরজা আটকে ভেতরে বসে থাকেন। তাদের সহায়তার জন্য কয়েকজন নেশাগ্রস্ত বহিরাগতদের সঙ্গে রাখা হয়। এসব বহিরাগত ‘সিট বাণিজ্য’ কারবারে সহায়ক হিসেবে কাজ করেন।

ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোনো যাত্রী টিকিট দেখিয়ে বগিতে উঠতে চাইলে তাদের বাঁধা দেওয়া হয়। তবে ১০০-২০০ টাকা দিলে যাত্রীদের বগিতে উঠতে দেওয়া হয়। এছাড়া দাঁড়িয়ে যেতে চাইলেও দিতে হয় ৫০ থেকে ১০০ টাকা। কেউ প্রতিবাদ করলে বগিটি তাদের জন্য বরাদ্দ ও এটাই নিয়ম বলে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়।

এভাবে একটি বগিতে ২০০ যাত্রীর কাছে গড়ে দেড়শ টাকা আদায় করলে মোট টাকা দাঁড়ায় ৩০ হাজার টাকা। এভাবে ৫-৬ টি বগিতে দিনে দেড় থেকে ২ লাখ টাকার নেওয়া হয়। এ বিষয়ে কেউ বাড়াবাড়ি করলে মারধরসহ বিভিন্ন অজুহাতে রেলওয় পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন: ‘আরএনবির কাণ্ড’ চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে সেনা সদস্যকে মারধর, আটক ৩

প্রতিদিন দুপুর সাড়ে ৩টায় চট্টগ্রাম থেকে ময়মনসিংহ বাহাদুরাবাদ ৩৭ নামের ট্রেনটি ছেড়ে যায়। এই ট্রেনেও চলে অভিন্ন টাকা আদায়। চট্টগ্রাম মেইল ট্রেনে যাত্রীর চাপ বেশি হওয়ায় সেটা নিয়েও চলে রমরমা বাণিজ্য। এছাড়া যেকোনো ছুটির দিনে যাত্রীর চাপ বেশি হলে রেটও বেড়ে যায়।

দীর্ঘদিন ধরে এভাবে টাকা আদায় করা হলে স্টেশন ম্যানেজার, মাস্টার, নিরাপত্তা বাহিনী ও প্লাটফর্ম স্টেশন মাস্টারসহ সবাই চুপ থাকেন। অভিযোগ রয়েছে, এই টাকার ভাগ চলে যায় একেবারে টপ লেভেল পর্যন্ত। সবার সম্মতিতে এভাবে টাকা আদায়ই এখন অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে।

নিয়ম অনুযায়ী, যেকোনো ট্রেন ছাড়ার আগে প্লাটফর্ম স্টেশন মাস্টার তদারকির কথা। কিন্তু টাকার ভাগ পাওয়ায় চুপ থাকেন তিনিও। অথচ এসব লোকাল ট্রেনের বেশিরভাগ যাত্রীই দিনমজুর ও স্বল্প আয়ের মানুষ। তাদের কাছ থেকে জোর করে নেওয়া হয় বাড়তি টাকা।

সূত্র জানায়, আরএনবি ও জিআরপি পুলিশের কিছু অসাধু সদস্য ছাড়াও কাউন্টারে বুকিং ক্লার্ক কাজী মতিনুল ইসলাম টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত। তিনি প্রতি টিকিটে একশ থেকে দেড়শ টাকা বাড়তি নেন। কোনো যাত্রী টাকা দিতে না চাইলে টিকিটি নেই বলে সাফ জানিয়ে দেন। টিকিটের বাড়তি দাম আদায়ের অপরাধে তাকে দুবার ফেনী ও ষোলশহর স্টেশনে বদলি করা হলেও তিনি তদবির করে ফের চট্টগ্রাম রেল স্টেশনে ফিরে আসেন।

যাদের যাত্রী সেবা নিশ্চিত করা এবং হয়রানি-অসুবিধা দেখার কথা সেই পিএসএম শরিফুল ইসলাম ও মাইন উদ্দিন মামুনের বিরুদ্ধেও রয়েছে অবৈধ আয়ের ভাগ নেওয়ার অভিযোগ। তাই আরএনবি ও জিআরপি পুলিশ সদস্যরা জোর করে বাড়তি টাকা আদায় করলেও তারা দেখেও না দেখার ভান করেন।

সিট বাণিজ্যে জড়িত চট্টগ্রাম কেবিনের পয়েন্টম্যান ফারুকও। তিনি পাহাড়তলী থেকে খালি বগিতে করে এসে সিটি দখল করে যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায় করেন। এমনকি তিনি ডিউটি না থাকলেও সিট বাণিজ্যে নিয়মিত অংশ নেন। এসব অনিয়ম যাঁর দেখার কথা সেই স্টেশন মাস্টার জাফর আহমেদও ওদের দলে। তাই সবকিছু জেনেও মুখ বন্ধ রাখেন তিনিও।

সম্প্রতি এক সেনা সদস্যকে মারধরের ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে গত ২৪ আগস্ট রাতে যৌথ বাহিনী অভিযান চালায়। এ ঘটনায় ৩ জনকে আটক করে র‌্যাব। এছাড়া ৪ জনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।

আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!