‘নেতাগিরি’ হটাতে মাঠে খোদ হিন্দুরাই, সাধুকে মারধরে শোধ নিতে মেধস মুনি আশ্রম ঘিরে পাহারা, সংঘাতের শঙ্কা

বোয়ালখালী করলডেঙ্গা পাহাড়ে সনাতনীদের গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান মেধস মুনি আশ্রম। প্রতিবছর দুর্গাপূজায় এখানে থাকে নানা আয়োজন। যার শুরুটা হয় মহালয়া থেকে। তবে গতবারের মতো এবারও এই আশ্রমে মহালয়ার আয়োজন ঘিরে দেখা দিয়েছে সংঘাতের শঙ্কা।

এদিকে সংঘাত এড়াতে পদক্ষেপ নিতে ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন স্থানীয় হিন্দু সংগঠনের নেতারা।

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, এবারের মহালয়ার আয়োজন ঘিরে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের চট্টগাম জেলা শাখার কয়েকজন নেতা ও স্থানীয় হিন্দু সমাজ। ওই নেতারা অবৈধভাবে অনুষ্ঠানে অনুপ্রবেশ করলে তা কঠোরভাবে প্রতিহতের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে স্থানীয় হিন্দু সমাজের নেতারা।

গত বছর দুর্গাপূজায় মহালয়ার দিন এ আশ্রমে ঘটেছিল এক ন্যাক্কারজনক ঘটনা। অভিযোগ রয়েছে, সেদিন আলোচনা সভার জন্য যজ্ঞ বন্ধ করে দেন চট্টগ্রাম জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের কয়েকজন নেতা। মহালয়ার সেই দিনে পূজা উদযাপন পরিষদ সভাপতি শ্যামল কুমার পালিত এবং পূজা উদযাপন পরিষদ চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক ও আনোয়ারা ৭ নম্বর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অসিম কুমার দেব আশ্রমের সেবায়েত বুলবুলানন্দ মহারাজকে মারধরও করেন। এবার কোনোভাবে ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি চায় না স্থানীয় হিন্দু সমাজ।

বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের বোয়ালখালীর আমুচিয়া ইউনিয়ন শাখা কমিটির আহ্বায়ক সঞ্জয় চৌধুরী আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ও ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনারের কাছে স্থানীয় হিন্দু সমাজ ইতিমধ্যে স্মারকলিপি দিয়েছে। কমিটি গঠনের আগে সেবায়েতের লিখিত অনুমতি লাগে। কিন্তু হঠাৎ নিয়ম-নীতি না মেনেই অবৈধ কমিটি দিয়েছে একটা চক্র। তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। হিন্দুদের অসহায়ত্বের সুযোগে এখানকার হিন্দুদের ‘পুতুল’ বানিয়ে খেলা করছে। মেধস মুনি আশ্রম বোয়ালখালী সংসদীয় আসনের আওতায়। অথচ কথায় কথায় শ্যামল পালিত ভয় দেখাচ্ছেন রাউজানের সংসদ সদস্যের। বোয়ালখালীর মন্দিরে রাউজানের সাংসদের কাজ কি? এছাড়া আনোয়ারা সদরের চেয়ারম্যান অসিম কুমার দেবও ভয় দেখান আরেক মন্ত্রীর। এসব তামাশা বোয়ালখালীর হিন্দু সমাজ মেনে নেবে না।

তিনি আরও বলেন, মেধস মুনি আশ্রমে যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে কোনো কমিটি নেই, পূজা কমিটির নেতাদের আমন্ত্রণ জানাবেন সেবায়ত। কিন্তু আমন্ত্রণ ছাড়াই আশ্রমে এসে তারা মাইক বাজিয়ে, হুঙ্কার দিয়ে বক্তব্য রাখবেন কেন? তাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বোয়ালখালীর হিন্দু সমাজ ঐক্যবদ্ধ। আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য ও নৈতিক দাবি আমরা ইতিমধ্যেই প্রশাসনকে জানিয়েছি। এরপরও যদি অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেন, তাহলে যেকোনো ধরণের পরিস্থিতির জন্য তাঁরাই দায়ী থাকবেন।

স্থানীয় হিন্দু সংগঠনের একাধিক নেতা জানান, মেধস মুনি আশ্রম দখলে নিতে পাঁয়তারা করছে নেতা সেজে দখলদাররা। তারাই হিন্দু সমাজকে বিভক্ত করে টুকরো টুকরো করে রেখেছে। প্রতিবছর দুর্গাপূজা এলেই হঠাৎ জেগে ওঠে তারা। শহর থেকে গায়িকা এনে গান গাওয়া কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান না। পূজা উদযাপন পরিষদের নেতাদের তো এখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। গতবছর মন্দিরে অনুপ্রবেশ করে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ সভাপতি শ্যামল কুমার পালিত এবং বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক ও আনোয়ারা ৭ নম্বর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অসিম কুমার দেব আশ্রমের সেবায়েত শ্রীমৎ স্বামী বুলবুলানন্দ মহারাজকে মারধর করেছিল। প্রশ্ন উঠেছে, কী স্বার্থে তারা এখানে অনুপ্রবেশ করছে। আমরা স্থানীয়রা কি মরে গেছি? এবার এ ধরনের কেউ অনুপ্রবেশ করলে সম্মান নিয়ে মন্দির থেকে ফিরতে পারবে না। জীবনের বিনিময়ে হলেও এবার অনুপ্রবেশকারীদের প্রতিরোধ করা হবে।

দেবীভাগবত পুরানের মতে, দেবী দুর্গা পৃথিবীতে সর্বপ্রথম ঋষি মেধসের এই আশ্রমে নেমে এসেছিলেন। তাই সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই আশ্রম অন্যতম শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান। প্রতিদিন অসংখ্য ভক্ত ও দর্শনার্থীতে মুখরিত থাকে এ আশ্রম।

দুর্গাপূজার উৎপত্তিস্থল হিসেবে স্বীকৃত মেধস মুনি আশ্রমে এবারও মহালয়ার আয়োজন থাকবে। তবে মহালয়ার আয়োজন ঘিরে সংঘাতের আশঙ্কা তৈরির পেছনে এবারও জেলা পূজা উদযাপন কমিটির নেতাদের হাত রয়েছে বলে মন্তব্য করেন আশ্রমের সেবায়ত শ্রীমৎ স্বামী বুলবুলানন্দ মহারাজ।

তিনি আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, মেধুস মুনি আশ্রমে আমি ২০০২ সাল থেকে টানা ২০ বছর সেবায়ত হিসেবে রয়েছি। গত ২৫ আগস্ট আমি ভারত গিয়েছিলাম। আমার ভারত যাওয়ার পরদিন তড়িঘড়ি করে নিয়মবহির্ভূত সভা করে একটা অবৈধ কমিটি গঠন করা হয়। বিধান অনুযায়ী, কমিটি গঠনে স্থানীয় সাংসদ, উপজেলা প্রশাসন ও সেবায়তের লিখিত অনুমতির প্রয়োজন থাকলেও তা মানা হয়নি। ওই সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য (চট্টগ্রাম-৮) মোছলেম উদ্দিন আহমদ দেশেই ছিলেন না। তিনি তখন সিঙ্গাপুর ছিলেন। তিনি দেশে ফিরে কমিটি গঠন করবে বলে জানিয়েছিলেন। সেটাও না মেনে অবৈধভাবে কমিটি গঠন করা হয়েছে। অবৈধ ওই কমিটি আশ্রমে মহালয়ার দিন কোনো অনুষ্ঠান করতে পারবেন না। এদিন বিভিন্ন যজ্ঞসহ শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে আশ্রমের পক্ষ থেকে। ভক্ত হিসেবে যেকেউই আসতে পারবে। তবে এখানে কাউকে অশাস্ত্রীয় কার্যকলাপ করতে দেওয়া হবে না।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি শ্যামল পালিত আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, মেধস মুনি আশ্রমের পূজা উদযাপন পরিষদের কোনো কমিটি গঠনে আমাদের হাত নেই। এখানে কমিটি দেওয়ার এখতিয়ার নেই আমাদের। আমরা গত ৩০ বছর ধরে এ আশ্রমে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছি, এবারও আমাদের আয়োজন থাকবে।

গত বছরের মতো এবারও মহালয়ার দিন এ আশ্রমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে— এমন আশঙ্কার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি ‘ব্যস্ত আছি’ বলে মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

এদিকে এ কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুকোমল চৌধুরী ১৩ বছর আগে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিরও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এ কমিটি গঠন করা হয়েছে ৫ বছরের জন্য। যদিও নিয়ম অনু্যায়ী, সর্বোচ্চ ৩ বছরের জন্য কমিটি গঠন করার কথা।

এ বিষয়ে সুকোমল চোধুরী আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, আশ্রমে কেন্দ্রীয় পূজা কমিটির মাধ্যমে অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে থাকে। আমি আগের কমিটিতেও ছিলাম, এবারও সাধারণ সম্পাদক পদে রয়েছি। এটা হচ্ছে খতিয়ানমূলে সেবায়ত শাসিত কমিটি।সেবায়তের পক্ষে একটা আশ্রম পরিচালনা কমিটি থাকে। সবকিছু এ কমিটির মাধ্যমে হয়ে থাকে। এ আশ্রম পরিচালনা কমিটির অনুমতি নিয়ে কেন্দ্রীয় পূজা কমিটি গত ৩০-৪০ বছর ধরে সেখানে যায়। আশ্রম দেখাশুনার কাজ করেন সাধু।

তিনি বলেন, এখানে কমিটি গঠনের জন্য স্থানীয় সাংসদ বা উপজেলা প্রশাসন কারও অনুমতির দরকার পড়ে না। এখানে তো কোনো সরকারি অনুদান নেই। লোকজন যায়, তাদের টাকায় এটা চলে। এখানে কমিটির মেয়াদ নিয়ে কোনো বিধান নেই।

তিনি আরও বলেন, কোথা থেকে এখানে এসে তিড়িংবিড়িং করছেন বুলবুল নন্দ মহারাজ। তিনি তো এখানের একজন কর্মচারী। তিনি যদি নিজে নিজে সাধু শ্রীমৎ স্বামী বুলবুলানন্দ মহারাজ হয়ে যান তাহলে তো হবে না। ওনাকে সেবায়েত কে বানিয়ছে? সেবায়ত তো হচ্ছেন অনুপম চৌধুরী। বুলবুল নন্দ মহারাজ কেন সেবায়ত হবেন? তাঁর তো আগে সাদা কাপড় ছিল, এখন নিজে নিজে শ্রীমৎ স্বামী বলেন। নিজে নিজে সাধু হয়ে গেলেন, তাঁর তো যজ্ঞ করারও যোগ্যতা নেই। তিনি তো কলকাতা চলে যাবেন।

এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক ও আনোয়ারার ৭ নম্বর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অসিম কুমার দেবকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন: পুলিশের প্রমোশনেও ‘বাণিজ্য’—’ওসি’ হলে বিয়ের লোভ দেখিয়ে ধর্ষণ, মেরে দিল ১০ লাখ টাকা

এদিকে শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকে মেধস মুনি আশ্রম ঘিরে পাহারা বসিয়েছে স্থানীয় হিন্দুরা। মধ্যরাতেও অন্তত ৩শ লোককে মন্দিরের নিচে অবস্থান করতে দেখা গেছে।

এর আগে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা মেধস মুনি আশ্রমে আগের মতো অনুষ্ঠান করতে ডেকোরেশন জিনিসপত্র পাঠায় ট্রাকে করে। তবে ডেকোরেশন সামগ্রী নিয়ে আসা ট্রাকটি বাধার মুখে পড়ে সন্ধ্যায় মন্দিরের সামনে থেকে ফিরে যায়।

যোগাযোগ করা হলে বোয়ালখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রাজ্জাক আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, এ বিষয়টা নিয়ে এর আগে মাননীয় সাংসদ, হিন্দু সংঠনের নেতা, সেবায়তসহ বৈঠক হয়েছিল। তখন তো সব ঠিকঠাক ছিল। সংঘাতের আশঙ্কার বিষয়ে আমাদের কাছে তথ্য নেই।

একই প্রসঙ্গে বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মামুন আলেকিত চট্টগ্রামকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমাদের সাথে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের আলাপ হয়েছে। হিন্দু সংগঠনের নেতাদের স্মারকলিপি দেওয়ার বিষয়টি জেনেছি। উপজেলা প্রশাসনে অনুলিপি পাঠালেও তা আমি এখনও পাইনি।

তিনি বলেন, মহালয়ার দিন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তো আমাদের কিছু করার নেই। তবে এ দিন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির কোনো শঙ্কা দেখা দিলে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিব।

আলেকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!