চট্টগ্রামে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন চুরির মামলার আসামি ‘সোর্স’ ইমরান, কোমরে ঝুলে ‘সাংবাদিক’ কার্ডও

কাঁধে ঝুলছে চুরির একাধিক মামলা। স্কুলের গণ্ডি পেরোতে না পারলেও সাংবাদিক পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন চট্টগ্রাম নগরে। শুধু তাই নয়, তিনি আবার র‌্যাব-পুলিশের সোর্স হিসেবেও পরিচয় দেন। কারো বিরুদ্ধে থানায় মামলা হলেই উপস্থিত হন আসামির সামনে। র‌্যাবের ক্রসফায়ারের তালিকায় নাম আছে বলে তা কেটে দেওয়ার নামে হাতিয়ে নেন টাকাও। কথিত এই সাংবাদিকের নাম মো. ইমরান (২৮)।

চুরি-ছিনতাই থেকে পেশা বদলে হঠাৎ সাংবাদিক হয়ে যাওয়া ইমরান আবার র‌্যাব-পুলিশের কথিত সোর্সও।

ইমরান পাঁচলাইশ থানার বিবিরহাট এলাকার বড় বাড়ির মৃত শাকু ইকবালের ছেলে। বর্তমানে চান্দগাঁও থানাধীন শমসেরপাড়া ডেন্টাল হাসপাতালের পেছনে চাঁন মিয়া আবাসিকের ছেনোয়ারা ম্যানশনের পাশে জিল্লুর কলোনিতে থাকেন। তবে তার বাবা শাকু মারা যাওয়ার পর মা আরেক বিয়ে করে সংসার করছেন।

চান্দগাঁও এলাকা ঘুরে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইমরান ছিল মূলত ছিচকে চোর। মোটরসাইকেল থেকে শুরু করে মানুষের কাপড়-চোপড় চুরির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। স্কুলের গণ্ডিতে পা না রাখা ইমরান এলাকার এক রাজনৈতিক ব্যক্তির হাত ধরে গড়ে তোলেন নিজের রাজত্ব। তার কোমরে ঝুলে ‘সাংবাদিকের’ আইডি কার্ড। ভয় দেখান সাধারণ মানুষকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের জুয়েল নামের এক ক্যামেরাপারসন ইমরানের বন্ধু। তার ছত্রছায়ায় স্কুলে পা না রেখেও ‘সাংবাদিক’ হয়ে গেছেন ইমরান।’ এই জুয়েলের সঙ্গে ইমরানের একাধিক ছবিও পাওয়া গেছে।

আরও পড়ুন: চট্টগ্রামে করোনার গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী

জানা যায়, র‌্যাব ও পুলিশের সোর্স পরিচয়ে এলাকায় তার বেশ খ্যাতি রয়েছে। র‌্যাবের ক্রসফায়ারের তালিকায় নাম আছে জানিয়ে বেশ কয়েকজন থেকে টাকাও হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। এমন অভিযোগের তথ্য এসেছে আলোকিত চট্টগ্রামে। সেই তালিকা থেকে নাম কাটানোর ব্যবস্থা করারও খ্যাতি তার রয়েছে লোকমুখে। তবে এ বিষয়ে জানে না র‌্যাব।

ইমরানের বিষয়ে র‌্যাব-৭ এর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈনের কাছে জানতে চাইলে তিনি আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, ‘এমন কেউ পরিচয় দিলে সরাসরি র‌্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করে র‌্যাব অফিসে নিয়ে আসার নির্দেশ রয়েছে। এ বিষয়ে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে সোচ্চার থাকতে হবে। অপরাধ দমনে র‌্যাব সবসময় জনগণের হয়ে কাজ করছে।’

অনুসন্ধানে ইমরানের বিরুদ্ধে চুরি, ছিনতাই, আধিপত্য বিস্তারে মারামারিসহ নানা অভিযোগ পাওয়া যায়। নগর ও উপজেলার বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মামলা।

২০১৬ সালের ২৯ অক্টোবর হাটহাজারী দক্ষিণ ছাদেকনগর এলাকা থেকে দুটি মোটরসাইকেল চুরি করে পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের হাতে আটক হন ইমরান। এ সময় তার বিরুদ্ধে হাটহাজারী থানায় চুরির মামলা দায়ের হয়। এ মামলায় তাকে প্রধান আসামি করে ২০১৭ সালের ৬ জুলাই চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোল্লা মো. জাহাঙ্গীর কবির।

২০১৭ সালের ২২ ডিসেম্বর ষোলশহর নাজিরপাড়া কবরস্থান এলাকায় জায়গার বিরোধ নিয়ে সাইফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তিকে মারধরের অভিযোগও রয়েছে ইমরানের বিরুদ্ধে। এ সময় সাইফুলের প্রায় দেড় লাখ টাকা মূল্যের মোবাইল ফোন, ঘড়ি ও নগদ টাকা ছিনিয়ে নেন তিনি। এ ঘটনায় নগরের পাঁচলাইশ থানায় তিনজনের নাম উল্লেখ করে এবং ১৫ থেকে ২০ জনাে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা হয়। সেই এজাহারে ইমরানকে ৩ নম্বর আসামি করা হয়।

এর আগে ২০১৭ সালের ২৪ জুন পূর্বশত্রুতার জের ধরে মুরাদপুর ১ নম্বর রেলগেট এলাকায় মো. রায়হান (৩৩) নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে বেতন-বোনাসের টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেন ইমরান ও তার সহযোগীরা। এসময় ইমরান ভুক্তোভোগীকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে তার দুহাত জখম করেন। পরে ছিনতাইয়ের অভিযোগে রায়হান পাঁচলাইশ থানায় ৪ জনকে আসামি ও ৪ থেকে ৫ জনকো অজ্ঞাত দেখিয়ে মামলা দায়ের করেন। মামলায় ২ নম্বর আসামি হিসেবে ইমরানের নাম রয়েছে।

আরও পড়ুন: এক যুবকের ব্যাগে ১৯৭ বোতল ফেনসিডিল, অন্যজনের ৫ কেজি গাঁজা

ভুক্তোভোগী এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, ‘থানায় রাজনৈতিক মামলা থাকার সূত্র ধরে ইমরান আমাকে জানায়, র‌্যাবের ক্রসফায়ারের লিস্টে আমার নাম রয়েছে। নাম কাটিয়ে দিতে আমার কাছ থেকে টাকা দাবি করেন ইমরান। অন্যথায় র‌্যাবের ক্রসফায়ারের হুমকি দেন। পরে বিভিন্ন সময়ে তিনি ফোনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমার কাছ থেকে দেড় লাখের বেশি টাকা হাতিয়ে নেন।’

এদিকে পাঁচলাইশ থানায় ইমরানের বিরুদ্ধে রয়েছে দুটি মামলা। অথচ পাঁচলাইশ থানার সোর্স পরিচয়েই মানুষকে হয়রানি ও ভয় দেখান তিনি! দিন-রাত ঘুরে বেড়ান থানা এলাকায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নাজিম উদ্দীন আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, ‘আমরা সোর্স লালন-পালন করি না। সে যদি এমন অপরাধ করে থাকে তবে তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তার বিরুদ্ধে যেসব মামলা আছে এতে সে জামিনে থেকে এমন কাজ করতে পারে।’

এদিকে অভিযোগ অস্বীকার করে মো. ইমরান বলেন, ‘আমি অপরাধ জগতের সাংবাদিক। এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।’

এরপর কোন এলাকা থেকে তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ এসেছে জানতে চান ইমরান। এসব বিষয়ের কল রেকর্ড রয়েছে বলে জানালে ইমরান বলেন, ‘আপনাদের অফিসে এসে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো।’

তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মামলার বিষয়ে বললে প্রথমে ইমরান অস্বীকার করেন। এরপর বলেন, ‘আপনি কি অফিসে আছেন। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে এখনই আসছি।’

ইমরানের সঙ্গে কথা বলার পর প্রতিবেদকের নম্বরে কল দেন কেএম রুবেল নামের এক ব্যক্তি। এ সময় তিনি ইমরানের বড় ভাই পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘এমন ফটকাবাজি সাংবাদিকতা কে শিখিয়েছে। তোমার সম্পাদককে বলবে কেএম রুবেল ফোন করেছে। সাংবাদিকতায় আমার আঠারো বছরের ক্যারিয়ার।’

কোথায় কাজ করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কোথায় কাজ করি সেটা তোর সম্পাদককে ফোন দে, সে বলবে।’ তার এমন আচরণের প্রতিবাদ জানালে তিনি বলেন, ‘তোমার নাম কি? আমি তোমার সম্পাদকের সঙ্গে এখনই কথা বলছি।’

আরও পড়ুন: কোটি টাকা মেরে—জেলে যেতে হবে সঙ্গীতশিল্পী আবদুল মান্নান রানাকে

জানা যায়, কেএম রুবেলের বিরুদ্ধেও অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। প্রতারণার মামলায় ২০১৭ সালের ৩০ জুন তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন গাজীপুরে। নীলা রোজারিও নামের এক ভুক্তভোগীর করা সেই মামলায় তার স্ত্রী রিমি আক্তারও আসামি ছিলেন। কেএম রুবেলের বাড়ি ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার আমজাদহাট এলাকার পশ্চিম বসন্তপুর গ্রামে। তিনি ওই এলাকার আব্দুল করিমের ছেলে। তার শ্বশুরবাড়ি কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের রায়েরদিয়ায়।

এদিকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির ক্যামেরাপারসন জুয়েলের কাছে এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, ‘আমার পরিচয় ব্যবহার করে যদি ইমরান অপরাধ করে এর দায়ভার আমি নেব না। তবে তার সঙ্গে আমার অনেক বছরের পুরনো বন্ধুত্ব। আমার পরিচয় ব্যবহার করে সে এমন করছে, এসব বিষয় আমার জানা ছিল না।’

আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!