চট্টগ্রামে খুলশীতে ‘গায়ের জোরে’ ভবন বানাচ্ছে স্যানমার, অভিযোগ গেল দুদকে

স্যানমার প্রপার্টিজের বিরুদ্ধে পাহাড় কেটে, নকশাবহির্ভূত ও অবৈধভাবে ভবন নির্মাণ বেশ পুরোনো অভিযোগ। চট্টগ্রাম নগরীর উত্তর খুলশীতে প্রতিষ্ঠানটির নির্মাণ করা ভবন ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশ থাকায় পার পেয়ে যাচ্ছে তারা।

তবে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ করেছেন এক ব্যক্তি। নকশাবহির্ভূতভাবে ৬ তলার বদলে নির্মাণ ১২ তলা ভবন ভেঙে পড়ার আশঙ্কায় এ অভিযোগ করা হয়। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে টাকা পাচারের অভিযোগও ওঠেছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।

জানা গেছে, ২০০৯ সালের ২২ জুন নগরীর উত্তর খুলশী ইম্পেরিয়াল হিলের ৪ নম্বর সড়কে ১০৯/সি নম্বর প্লটে ‘স্যানমার গ্রানডি’ নামের একটি ভবন তৈরির জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) থেকে ছয়তলা ভবন নির্মাণের জন্য নকশা নেয় স্যানমার প্রপার্টিজ লিমিটেড নামের আবাসন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। ১০ থেকে ১২ ফুট প্রশস্ত রাস্তায় ছয়তলা ভবনের বেশি সিডিএ থেকে অনুমোদন দেওয়ার নিয়ম না থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি ১২ তলা নির্মাণের কাজ করে। এছাড়া আইন অনুযায়ী দু’বছরের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ করার কথা। কিন্তু সিডিএর কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায় পুনরায় নকশা নিয়ে এখনও কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, জমির ৬৫ শতাংশ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। বাকি ৩৫ শতাংশ খালি রাখতে হয়। কিন্তু এ ভবন নির্মাণে ব্যবহার হয়েছে ৮৮ শতাংশ জায়গা।

এদিকে ছয়তলার পরিবর্তে ১২ তলা ভবন নির্মাণের বিষয়টি আশপাশের ভূমি মালিকদের দৃষ্টিগোচর হলে এই বিষয়ে তারা সোচ্চার হন। ২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর এই বিষয়ে ১১জন স্থানীয় বাসিন্দা স্বাক্ষর করে সিডিএ বরাবর অভিযোগ দেন। এতে স্যানমার প্রপার্টিজের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও চেয়ারম্যান এম মাসুক হককে দায়ী করা হয়।

কিন্তু এ বিষয়ে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নেয়নি সিডিএ। বিষয়টি ধামাচাপা দিতে গত ২০২১ সালের ৬ জুন এই ভবনের সংশোধনী নকশার জন্য আবেদন করে আবাসন প্রতিষ্ঠানটি। তার বিপরীতে একই বছরের ৮ জুন নির্মাণাধীন এই ভবনের ক্ষতিকর বিষয়গুলো উল্লেখ করে এসএ গ্রুপের চেয়াম্যানের পক্ষে আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন সৈয়দ রাফিদুল আলম। মামলায় সমন জারির পরও নির্মাণকাজ পরিচালনা করায় একই বছরের ১৯ জুন নগরের খুলশী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করা হয়। এর আগে করোনাকালীন সময়ে সরকারি বিধিনিষেধ না মেনে নির্মানকাজ পরিচালনা করায় একই বছরের ২৯ এপ্রিলও একটি জিডি করা হয়।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী ভবনটির উত্তর পাশে তিন মিটার দূরত্বের বদলে মাত্র পৌনে এক মিটার রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। একইভাবে দক্ষিণ পাশে তিন মিটারের পরিবর্তে এক মিটার, পূর্ব দিকে দেড় মিটারের পরিবর্তে এক মিটার এবং পশ্চিম পাশে তিন মিটারের পরিবর্তে দূরত্ব রাখা হয়েছে মাত্র দেড় মিটার। ওই সময় ভবনটির ১০ তলার নির্মাণকাজ শেষ হয়।

অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, পাহাড়ের ঢালু জায়গার ওপরের অংশে বহুতল ভবন নির্মাণ করায় পাহাড়ধস, ভূমিকম্পসহ যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে আশপাশের অন্তত ১২টি প্লটের মালিক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া বসবাসরত মানুষের প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। একইসঙ্গে পাহাড় কেটে এই ভবন নিার্মণের কারণে এ ঝুঁকি আরও বেড়েছে। রাস্তা সরু হওয়াতে অগ্নিকাণ্ডে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি চলাচলেও বিঘ্ন ঘটবে।

এদিকে একই বছরের ২৩ জুন মামলা চলমান থাকার কারণে সংশোধনী নকশার বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে সিডিএ’র চিফ প্ল্যানার বরাবর আবেদন করা হয়। এতে ইমারত নির্মাণ আইন ১৯৫২, ইমারত নির্মাণ আইন ২০০৮, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫, অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন ২০০৩, সিভিল এভিয়েশন আইন, সিডিএ আইন ২০০৮-এ বিধিমালা লঙ্ঘন করে এ ভবন নির্মাণেে কথা বলা হয়।

একইদিনে অভিযোগ করা হয় গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক বরাবর। এর আগের দিন অর্থাৎ ২২ জুন পাহাড় কাটার বিষয়ে অভিযোগ করা হয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক বরাবর। প্রতিটি অভিযোগে স্যানমার প্রপার্টিজ লিমিটেডের পক্ষে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর এম মাসুক হক, প্রজেক্ট ম্যানেজার সেলিম বিন সালেহ, প্রজেক্ট ডিরেক্টর সফিকুর রহমান, ম্যানেজার (এডমিন) মো. মাইনুল হক ও এডমিন ম্যানেজার এহসানুল বারীকে দায়ী করা হয়েছে।

কিন্তু এতে কোনো উপকার পায়নি আশপাশের স্থায়ী বাসিন্দারা। আদালেতের নির্দেশে মাত্র ২১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে ১২ তলা ভবনের নির্মাণকাজ পরিচালনা করছে এ আবাসন প্রতিষ্ঠান। এতে মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কার কোনো সুরাহা হয়নি।

এছাড়া ২০২১ সালের ১২ আগস্ট মামলা চলাকালীন সময়ে সংশোধনী নকশার আবেদন অনুমোদন না করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সিডিএ চেয়ারম্যান, সচিব, চিফ ইঞ্জিনিয়ার, চিফ প্ল্যানার, অতিরিক্ত চিফ প্ল্যানার, অথরাইজড অফিসার-১ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু এতেও কোন কাজ হয়নি।

পরে ২০২২ সালের ১ আগস্ট দুর্নীতি দমন কমিশন বরাবর অভিযোগ দায়ের করেন মো. পরভেজ হোসেন নামের এক ব্যক্তি। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, স্যানমার প্রপার্টিজ, সিডিএ সংশ্লিষ্ট অথরাইজড অফিসারসহ প্ল্যানিং বিভাগের কর্তব্যরত কর্মকর্তাদের অন্যায়ভাবে লাভবান করে ছয়তলা প্ল্যান নিয়ে ১২ তলার ভবন নির্মাণ করে। স্থানীয় লোকজন আপত্তি ও অভিযোগ করার পরও অবৈধ ও অন্যায় কাজকে বৈধতা দেওয়ার জন্য চলতি বছরের ২৩ জুন তাদের কথামতে ৪টা বেসমেন্টসহ আটতলা ভবনের অনুমোদন দেওয়া হয়।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!