আড়াই মাস বয়সী শাহিদা হক। তার জন্মের ঠিক দুদিন আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা কারবারি একরামের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন তার বাবা লবণচাষি নুরুল হক ভুট্টো।
বৃহস্পতিবার (৪ আগস্ট) চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব ভবনের এস রহমান হলে হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইতে আসেন বাবা হারানো শাহিদা হক, বড় ভাই তৌহিদুল ইসলাম (১৩), বোন আয়েশা সিদ্দিকা (৭) ও তাদের মা নাসরিন সুলতানা। এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে সূদুর টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড নাজিরপাড়া থেকে আসেন তারা।
তাদের আর্তনাদে এস রহমান হলরুমে শোকের আবহ নেমে আসে। এসময় উপস্থিত ছিলেন নিহত নুরুল হক ভুট্টোর ছোট ভাই নুরুল আবসার খোকন, নুরুল ইসলাম নুরু, তাদের মা আবেদা খাতুন, সাবেক ওসি প্রদীপের ক্রসফায়ারের শিকার ভুট্টোর বড় ভাই নূর মোহাম্মদের স্ত্রী লায়লা বেগম, ভাগিনা বেলাল এবং নুরুল আবছার। আরও উপস্থিত ছিলেন কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজনীন সরোয়ার কাবেরী।
আরও পড়ুন: সাংবাদিকের ‘কার্ড’ ঝুলিয়েও রেহাই পেল না র্যাবের কথিত সোর্স ইমরান
নিহত ভুট্টোর ছোট ভাই নুরুল ইসলাম নুরু লিখিত বক্তব্যে গণমাধ্যমকে জানান, চলতি বছরের ১৫ মে (রোববার) আমার বড় ভাই নুরুল হক ভুট্টোকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে ইয়াবা কারবারি একরাম ও তার সহযোগীরা। সেদিন পাশের সাবরাং ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নুর হোসেনের অনুরোধে একটি মোটরসাইকেল এক্সিডেন্টের সালিশে আমার ভাই ভাগিনাসহ যান। সালিশ থেকে বাসায় ফেরার পথে সাবরাং ইউনিয়নের বড় হাবিরপাড়া থানার ডেইল এলাকায় তাদের ওপর হামলা হয়। আমার ভাই হামলার মুখে জীবন বাঁচাতে দৌড়ে একটি মসজিদে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেন। কিন্তু হামলাকারীরা চাইনিজ কুড়াল এনে মসজিদের দরজা কেটে তাকে কুপিয়ে হত্যা করে। মৃত্যু নিশ্চিত করার পর হত্যাকারীরা আমার ভাইয়ের ডান পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ কেটে কাঁধে নিয়ে বিজয় উল্লাস করতে করতে চলে যায়।
তিনি বলেন, খুনিরা সেই পা সনাতন ধর্মালম্বীদের চিতায় পুঁতে ফেলে। আমার ভাইকে দাফন করতে হয়েছে এক পা ছাড়াই। এর আগে গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৮ নম্বর ওয়ার্ডে মেম্বার পদের প্রার্থী হন আমার চাচাতো ভাই এনামুল হক। তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন একরামের চাচা আলী আহমদ। এলাকায় আমার ভাইয়ের পরিচ্ছন্ন ইমেজের কারণে নির্বাচনে আমার চাচাতো ভাই বিপুল ভোটে জয়ী হন। মূলত সেই থেকেই আমার ভাইয়ের ওপর ক্ষুদ্ধ ছিল একরাম ও তার বাহিনী।
তিনি আরও বলেন, হত্যাকাণ্ডের পরদিন ১৬ মে ১৭ জনকে এজহারভুক্ত এবং অজ্ঞাত আরো ৮/১০ জনকে আসামি করে টেকনাফ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করি। মামলার সূত্রে পুলিশ ৭ জনকে গ্রেপ্তার করলেও মূল আসামি ইয়াবা সম্রাট একরাম এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ নানা মাধ্যমে আসামিরা আমাদের হুমকি দিচ্ছে। এতে আমার পরিবার অনিরাপদ বোধ করছে। পরিবারের নিরাপত্তা ও ভাইয়ের হত্যার বিচারের জন্য গণমাধ্যমের সাহায্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, সবচেয়ে নির্মম বিষয় হলো, একরামের অনুগত কথিত সাংবাদকর্মীরা তার পক্ষ নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। দুই ইয়াবা কারবারির ইয়াবার টাকা ভাগাভাগির দ্বন্দ্বে আমার ভাই নিহত হয়েছে জানিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছেন তারা। মূলত একরামকে হত্যার দায় থেকে মুক্তি দিতে এই হত্যাকাণ্ডকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। অথচ আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে কোথাও ইয়াবা সংক্রান্ত মামলা নেই। জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মাদক কারবারি টেকনাফের মো. একরাম ডাকাতের ভুল তথ্যে র্যাবের ‘ক্রসফায়ারের বলি’ হন পৌর কাউন্সিলর ও স্থানীয় যুবলীগের সাবেক সভাপতি মো. একরামুল হক। যে ঘটনার একটি ভয়েস রেকর্ডিংয়ে অশ্রু ঝরেছে দেশের অসংখ্য মানুষের। এদিকে ইয়াবা সম্রাট একরামের জীবন বৃত্তান্ত থেকে জানা যায়- তার বিরুদ্ধে মাদক, অস্ত্র, হত্যা মামলা, মানি লণ্ডারিংসহ টেকনাফ থানায় ১৩টি ও কক্সবাজার সদর থানায় ৩টি মামলা রয়েছে।
নুরুল হক ভুট্টোর মা আবেদা খাতুন বলেন, কোনো ধরনের অভিযোগ বা মামলা না থাকা সত্ত্বেও ৪০ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাস আমার বড় ছেলে নূর মোহাম্মদকে তার স্ত্রীর সামনে ক্রসফায়ারে হত্যা করেন। পারিবারিকভাবে আমার ছেলে নুর মোহাম্মদ লবণচাষি ছিল। সেই সময় ওসি প্রদীপ আমার ছেলে নুর মোহাম্মদকে ইয়াবা কারবারি তকমা দিয়ে ৪০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। অন্যথায় ক্রসফায়ারের হুমকি দেন। ক্রসফায়ার থেকে বাঁচতে জমানো কিছু লবণ ও স্ত্রীর স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করে ওসি প্রদীপকে ৫ লাখ টাকা দেয় নূর মোহাম্মদ। ৫ লাখ টাকা নিয়ে ওসি প্রদীপ আমার ছেলের বউ লায়লা বেগমের সামনেই নূর মোহাম্মদকে ক্রসফায়ার দেন।
তিনি আরও বলেন, আমার মেঝ ছেলে নুরুল হক ভুট্টোকে নৃশংসভাবে হত্যা করে ডাকাত একরাম ও তার গ্রুপের লোকজন। তারপরও হত্যাকারীরা আমার পরিবারকে প্রতিনিয়ত হত্যার হুমকি দিয়ে আসছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে আমার পরিবারকে রক্ষার আকুতি জানাচ্ছি। দুই সন্তানকে হারিয়েছি। বাকি দুই সন্তানকে হারাতে চাই না।
মামলার অভিযুক্তরা হলেন, টেকনাফ সদর মৌলভীপাড়ার ফজল আহমদের ছেলে একরাম প্রকাশ একরাম ডাকাত (৩৫), তার ভাই আব্দুর রহমান (৩৫), আব্দু রাজ্জাক (৩৮), মোহাম্মদ রিদুয়ান (২৮), নাজিরপাড়ার মৃত মো. আমিনের ছেলে তৌকির আহমদ (৩০), সাবরাং ইউপি মন্ডলপাড়ার মৃত কবির আহমদ প্রকাশ কালা কবিরের ছেলে নুরুল আলম (৪০), মৃত আবুল কাশেমের ছেলে মো. সাদ্দাম (৩০), সুলতান আহমদের ছেলে আব্দুল আমিন (৩২) (বর্তমানে কারাগারে), হাজী ফজল আহমদ (৬৫), আলী আহম্মদ (৬০), আবু বক্কর প্রকাশ ভক্কো (৩৬) (বর্তমানে কারাগারে), রহীমুল্লাহ (২৮) (বর্তমানে কারাগারে), আব্দুল খালেক (২৮) (বর্তমানে কারাগারে), লেড় আহাম্মদ প্রকাশ লেইট্টা’র ছেলে মো. আবদুল্লাহ (৪০) (বর্তমানে কারাগারে), বশির আহমদ (৪৫) (বর্তমানে কারাগারে), সাইফুল ইসলাম ও ফয়সালসহ (১৮) অজ্ঞাত ৮ থেকে ১০ জন।
আরএস/এসআর