একাত্তরের বীর, জেলে জেলেই কেটেছে জীবন—সাঁঝবেলাটা কি রাঙাতে পারবেন চট্টগ্রামের ইউনুছ?

আওয়ামী লীগের লড়াকু এক সৈনিকের নাম ইউনুছ। উত্তাল একাত্তরে যিনি পাকিস্তানের পতাকায় আগুন দিয়ে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে রাজপথে নেমেছিলেন।

দেশের প্রয়োজনে, দলের প্রয়োজনে বরাবরই অকুতোভয় সৈনিক ইউনুছ। জীবনের বিশাল একটা সময় জেলে কাটিয়েছেন, সহ্য করেছেন একের পর এক নির্যাতন; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শ থেকে কখনো সরে আসেননি এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের তালিকা করলে প্রথমদিকেই থাকবে ইউনুছের নাম। কিন্তু কিছু পাওয়ার তালিকা করলে সেখানে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার নামটিই হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে না!

জীবনের শেষবেলা অতিক্রম করছেন আওয়ামী লীগের এই বীর। যুগের পর যুগ দলের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করা এই মুক্তিযোদ্ধা পৃথিবী থেকে বিদায় থেকে নিতে চান মানুষের সেবা করে, একটু সম্মান নিয়ে। তাই তিনি চট্টগ্রাম জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদের জন্য মনোনয়পত্র নিয়েছেন। লক্ষ্য একটাই, শেষ বয়সে দেশ ও দশের সেবা করে সম্মানিত হওয়া।

রোববার (৪ সেপ্টেম্বর) মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন মো. ইউনুছ। আজ (৫ সেপ্টেম্বর) মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।

জানা যায়, গত ২৩ আগস্ট জেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তফসিল অনুযায়ী, ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মনোনয়নপত্র দাখিল করতে হবে। মনোনয়নপত্র বাছাই হবে ১৮ সেপ্টেম্বর। মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের বিরুদ্ধে আপিল দায়েরের সময় ১৯ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর। ২২ থেকে ২৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তি করা হবে। ২৫ সেপ্টেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময়। ২৬ সেপ্টেম্বর প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হবে। ভোটগ্রহণ হবে ১৭ অক্টোবর।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, দলের জন্য জীবন শেষ করলাম তবে কোনো পদে নেই। যদি দল থেক মনোনয়ন দেয় নির্বাচন করবো। আমার শপথ ছিল, যতদিন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসিতে ঝুলাতে পারবো না ততদিন আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুতনয়া শেখ হাসিনার কাছ থেকে কিছু চাইব না। এখন আমি চাইছি।

তিনি বলেন, আমার মতো দলের জন্য দীর্ঘদিন কারাবরণ ও নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করেছে এমন কোনো মানুষ বাংলাদেশে নেই। নেতাদের ডিঙিয়ে যেতে পারিনি বলে পদ-পদবিও নেই।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ ১৯৫৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হাটহাজারীর নুর আলী মিয়ার হাট ফরহাদাবাদ গ্রামের হিম্মত মুহুরী বাড়ীর মরহুম নুর হোসেনের সন্তান। তাঁর বাবা ছিলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক উচ্চতর হিসাব কর্মকর্তা।

বর্তমানে নগরের দক্ষিণ খুলশী আবাসিক এলাকার ১নং সড়কের ৬৯নং বাড়িতে বসবাস করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ। তিনি উত্তাল একাত্তরে চট্টগ্রাম পূর্বাঞ্চলের সম্মুখযোদ্ধা ছিলেন। চট্টগ্রাম কারাগার থেকে বি.কম পরীক্ষায় অংশ নিয়ে তিনি ডিগ্রি পাস করেন।

১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঐতিহাসিক লালদিঘীর ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় পাকিস্তানি পতাকা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেন ইউনুছ। পরদিন ৩ মার্চ বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে চট্টগ্রামের রাজপথ প্রদক্ষিণ করেন।

২৭ মার্চ পাক নৌ-কমান্ডোর সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরে প্রথম সংঘর্ষ এবং রাইফেলসহ গ্রেপ্তার হন তিনি। ২ মাস ৬ দিন ধরে শারীরিক নির্যাতন সহ্য করে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে পালিয়ে ভারত পাড়ি দেন। ভারতের উত্তর প্রদেশ দেরাদুন তানদুয়ায় ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধের সামরিক প্রশিক্ষন নেন তিনি। উচ্চতর গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন ইউনুছ।

এদিকে জিয়াউর রহমানের সামরিক জান্তা আমলে ১৯৭৬ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ যুদ্ধ করতে গিয়ে ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে গোয়েন্দা সংস্থার হাতে গ্রেপ্তার হন। এরপর তাঁকে ঢাকা সেনানিবাসে ৯ দিন, কুমিল্লা সেনানিবাসে ৩ দিন এবং চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ১ মাস ২৮ দিন শারীরিক নির্যাতন করে চট্টগ্রাম কারাগারে পাঠানো হয়।

১৯৮০ সালে কারাগার থেকে মুক্তির পর একাধিকবার দিল্লি যান। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তিনি দিল্লির পানদার রোডের বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। এরপর দেশে ফিরে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এতে সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন ডা. এসএ মালেক।

জননেত্রী শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত কর্মী হিসেবে সবসময় সঙ্গে ছিলেন। সঙ্গে আরো ছিলেন যুবলীগ নেতা আবুল কাশেম মন্টু (সুত্রাপুর), ছাত্রনেতা হুমায়ন, জাহেদ প্রমুখ। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে পরিকল্পিত আক্রমণের সময়ে সার্বক্ষণিক নেত্রীর সঙ্গে ছিলেন তিনি। মো. ইউনুছ জানান, ‘সেই সময় সাথে ছিলেন নজীব ভাই।’

তিনি বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. এসএ মালেক (মহাসচিব, বঙ্গবন্ধু পরিষদ), সাবেক মন্ত্রী মরহুম জহুর আহম্মদ চৌধুরী, মরহুম এমএ আজিজ, মরহুম এমএ হান্নান, মরহুম এমএ মান্নান, মরহুম আক্তারুজ্জামান চৌধুরী (বাবু), মরহুম আতাউর রহমান খান কায়সার, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোশারফ হোসেন এমপি, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মৌলভী সৈয়দ আহম্মদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক মেয়র মরহুম এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে সুদীর্ঘ সময় সংগঠনের কর্মকাণ্ডে ছিলাম।

জেলে জেলেই জীবন
১৯৬৯ সালে গ্রেপ্তার হয়ে ১৫ দিন কারাগারে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি বাতিলের আন্দোলনে যুক্ত থেকে পাকিস্তান সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে ৯ মাস সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯৭৬ সালে ‘বিশেষ সামরিক আদালত- ৪’ এ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলায় ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৮০ সালের ১ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দিজীবন কাটান। চার বছরের কারাজীবনে দুবছর কাটিয়েছেন কনডেম সেলে।

ছাত্রলীগের স্কুল সভাপতি থেকে নগর সভাপতি
এ বীর মুক্তিযোদ্ধা ১৯৬৮ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল হাই স্কুল ছাত্রলীগ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা সর্বদলীয় মাধ্যমিক স্কুল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ছিলেন। ১৯৭০ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সহসাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২-৭৩ সালে চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত দুই মেয়াদে চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দি অবস্থায় চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮০ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র আজম নাছির উদ্দিন।

এরপর ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত দুবার বাংলাদেশ ছাত্রলীগ জাতীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহসম্পাদক হন। ১৯৮৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন।

অন্যান্য

বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ বর্তমানে চট্টগ্রাম মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পরিষদের মহাসচিব এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ যোদ্ধা ফোরাম ‘৭৫ এর আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এছাড়া তিনি চট্টগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ বিদ্যালয় শিক্ষা বোর্ড সদস্য, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য, চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালের আজীবন সদস্য, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, চট্টগ্রাম জেলার আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী সমিতির আজীবন সদস্য, চট্টগ্রাম শহর সমাজসেবা প্রকল্প সমন্বয় পরিষদ- ১ এর আজীবন সদস্য এবং পৌর জহুর হকার মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক।

চট্টগ্রাম জেলার আরও খবর পড়ুন

এসআই/আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!