একটুও বুক কাঁপেনি চালকের, ৭ ভাই—বোনকে গাড়িচাপা দিয়ে মালিকের ইন্ধনেই পালায়

বান্দরবানের রাবার বাগানে চাকরি করত সাইফুল। হঠাৎ সে বনে যায় চালক। ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলেও সে দিব্যি চালাতে থাকে পিকআপ, চাঁদের গাড়ি, ট্রাক! যার সর্বশেষ পরিণতি— চকরিয়ার মালুমঘাটে পাঁচ ভাই নিহত। বেপরোয়া গতিতে পিকআপ চাপা দেওয়ার এ ঘটনার কথা স্বীকারও করেছে গ্রেপ্তার চালক সাইফুল।

এদিকে চার বছর ধরে পিকআপের ফিটনেস ও ট্যাক্স টোকেন এবং তিন বছর ধরে রুট পারমিট মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল।

আরও পড়ুন : চকরিয়ায় ৫ ভাই নিহত—ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার ঘাতক চালক

পিকআপ চালিয়ে বিভিন্ন জায়গায় সবজি পৌঁছে দিতো সাইফুল। ঘটনার দিন কক্সবাজারে দ্রুত সবজি পৌঁছাতে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিল সে। রাস্তায় ঘন কুয়াশার কারণে ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না। সেইসঙ্গে পিকআপটি প্রায় ৭০ কিলোমিটার গতিতে চলছিল। মালুমঘাট বাজারের নার্সারি গেটের সামনে রাস্তার পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল আট ভাইবোন ও তাদের পরিবার। দূর থেকে তাদের দেখতে পায়নি সাইফুল। এছাড়া গাড়ি বেপরোয়া গতিতে থাকায় নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে দুর্ঘটনা ঘটায়।

শনিবার (১২ ফেব্রুয়ারি) বেলা সাড়ে ১২টায় কারওয়ান বাজার র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

এর আগে শুক্রবার (১১ ফেব্রুয়ারি) ঢাকার মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে ঘাতক চালক শহিদুল ইসলাম ওরফে সাইফুলকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-১৫। সে বান্দরবান জেলার লামা এলাকার মো. আলী জাফরের ছেলে।

সংবাদ সম্মেলনে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরো বলেন, দুর্ঘটনার সময় সাইফুলের সঙ্গে পিকআপ মালিকের ছেলে তারেক ও ভাগিনা রবিউল ছিল। গাড়ি হঠাৎ থামানোর জন্য ব্রেক করলেও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রায় ১০০ ফুটের মতো সামনে চলে যায়। পরে সাইফুল পিকআপ থেকে নেমে নিহতদের দেখতে আসতে চাইলে তারেকের নির্দেশে দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। এরপর মালুমঘাট বাজারের একটি স্থানে গাড়ি থামিয়ে মালিককে ফোন করে দুর্ঘটনার বিষয়টি জানায়। গাড়ির মালিক তাকে পিকআপটি পরবর্তী কোনো এক স্টপেজে রেখে লোকাল বাসে করে এসে তার দেখা করতে বলে।

মালিকের নির্দেশনা অনুযায়ী সাইফুল ডুলাহাজারায় এসে পিকআপটি রাখে এবং লোকাল বাসে করে চকরিয়া গিয়ে মালিকের সঙ্গে দেখা করে। পিকআপের মালিক মাহমুদুল এক বছর আত্মগোপনে থাকার পরামর্শ দিলে সাইফুল প্রথমে তার আগের কর্মস্থল বান্দরবানের লামার রাবার বাগানে আত্মগোপনে যায়। পরে জানাজানি হওয়ার ভয়ে ঢাকায় চলে যায়।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরো জানান, সাইফুলের কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। সে ২ বছর ধরে পিকআপ, চাঁদের গাড়ি ও ট্রাকসহ বিভিন্ন গাড়ি চালাচ্ছে। দুর্ঘটনার এক সপ্তাহ আগে সে পিকআপের মালিকের কাছ থেকে দৈনিক ৫০০ টাকা মজুরি ভিত্তিতে গাড়ি চালানো শুরু করে। এর আগে সে বান্দরবানের লামাতে একটি রাবার বাগানে চাকরি করত বলে জানা যায়।

এছাড়া পিকআপের মালিক মাহামুদুল করিম কক্সবাজার জেলার চকরিয়া থানাধীন মালুমঘাট এলাকার শামছুল আলমের ছেলে। তিনি সবজি পরিবহনের ব্যবসা করেন। চকরিয়ার সবজির আড়ৎ থেকে কক্সবাজার সদর ও মহেশখালী এলাকায় সবজি সরবরাহ করেন তিনি। তার ছেলে তারেক সবজি সরবরাহের তদারকি করেন এবং ভাগিনা রবিউল সহযোগী হিসেবে কাজ করেন।

২০১৬ সালে পিকআপটি কিনেছিলেন মাহমুদুল। কিন্তু গত চার বছর ধরে পিকআপের ফিটনেস ও ট্যাক্স টোকেন এবং তিন বছর ধরে রুট পারমিট মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল।

গত ৩০ জানুয়ারি সুরেশ চন্দ্র সুশীল বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান। ৮ ফেব্রুয়ারি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অংশ হিসেবে শ্মশান থেকে কাজ শেষ করে ক্ষৌরকর্মের জন্য বাড়ি ফিরতে আট ভাইবোন মালুমঘাট বাজারে রাস্তা পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় ভোর ৫টার দিকে কক্সবাজারমুখী বেপরোয়া গতিতে একটি পিকআপ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাদের চাপা দেয়।

আরও পড়ুন : ৫ ছেলের লাশের পাশেই এক মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ

এতে একই পরিবারের চার ভাই অনুপম সুশীল (৪৬), নিরুপম সুশীল (৪০), দীপক সুশীল (৩৫) ও চম্পক সুশীল (৩০) ঘটনাস্থলেই মারা যান। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান অপর ভাই স্মরণ সুশীল (২৪)। দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন তাদের ভাই রক্তিম সুশীল এবং বোন হীরা সুশীল। বর্তমানে রক্তিম নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন।

নিহতদের ভাই প্লাবন সুশীল (২২) বাদি হয়ে অজ্ঞাত পিকআপ চালককে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। এরপর ঘটনাটি দেশজুড়ে আলোচিত হলে তদন্তে নামে র‌্যাব।

বলরাম/ডিসি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!