সেন্টমার্টিনে বর্গির হানা—দ্বীপ ধ্বংসে যেন ‘স্লো পয়জন’ কৌশল

দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে আবারও বর্গিরা হানা দিয়েছে। দ্বীপ ধ্বংস করতে যেন ‘স্লো পয়জন’ পদ্ধতি বেছে নিয়েছেন দানবিক ব্যবসায়ীরা। তারা একের পর এক হোটেল-মোটেল-কটেজ বানিয়ে মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন করতে চাইছেন প্রকৃতির অপার সম্ভাবনাময় এ দ্বীপকে।

আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই নতুন আবাসিক হোটেল ও কটেজ নির্মাণের কাজ চলছে। অথচ দ্বীপে পাকা স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ এবং নির্মিত সব স্থাপনা উচ্ছেদ করতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশনা আছে। এ নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে পাঁচ বছর আগে দ্বীপে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ১০৪টি আবাসিক হোটেল ভাঙারও নির্দেশ দেন আদালত। এ আদেশ বাস্তবায়ন তো দূরের থাকুক, পর্যটন মৌসুমকে সামনে রেখে নতুন অর্ধশতাধিক পাকা দালান উঠছে সেন্টমার্টিনে। এভাবে চলতে থাকলে বিশ্বখ্যাত দ্বীপটি হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলছেন, অবৈধভাবে নতুন করে স্থাপনা নির্মাণের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বিশেষ করে দ্বীপে পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।

এদিকে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. পারভেজ চৌধুরীর দাবি, সেখানে এমন কোনো ঘটনা ঘটছে না। তিনি বলেন, নতুন করে মালপত্র নিয়ে দালানকোঠা নির্মাণের কোনো সুযোগ নেই। সম্প্রতি অবৈধভাবে মালপত্র নেওয়ায় আট জনের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে। তবু কেউ যদি দালনকোঠা করে থাকে সে বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেন্টমার্টিন রক্ষায় যার যার অবস্থান থেকে সবাইকে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

আরও পড়ুন: ‘ক্ষোভে ফুঁসছে চট্টগ্রাম’ সিআরবির বুকে উঠছে কংক্রিটের উঁচু ভবন

যারা এসব স্থাপনা নির্মাণ করছেন, তারা কোনো আইন তোয়াক্কা করতে রাজি নন। তারা উল্টো প্রশ্ন করছেন, ‘অনুমতি কেন নিতে হবে’? আবার কেউ বলছেন, ‘অন্যরা করেছে তাই আমিও করছি।’

দ্বীপের জেটিঘাট থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে উত্তর সমুদ্রসৈকতের তীরে পশ্চিমপাড়ার অবস্থান। সেখানে ‘নিঝুম বাড়ি’ আবাসিক হোটেলে দোতলার কাজ করছেন নির্মাণ শ্রমিকরা। এর আশপাশে আরও কয়েকটি কটেজ নির্মাণের কাজ চলছে পুরোদমে। এসব নির্মাণকাজে ব্যবহৃত হচ্ছে শত বছরের সঞ্চিত প্রবাল পাথর। এভাবে দ্বীপের পূর্বপাড়া, মাঝেরপাড়া, কোনাপাড়াসহ কয়েকটি পাড়ায় অর্ধশতাধিক দালানকোঠা নির্মাণের কাজ চলছে।

শুধু তাই নয়; সৈকত সংলগ্ন এলাকায় হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট ও দোকান নির্মাণের জন্য কেয়াবন ও ঝোপঝাড় ধ্বংস করা হচ্ছে। হোটেলে চলা জেনারেটরের আওয়াজে দ্বীপে বেড়ে চলেছে শব্দদূষণ। দ্বীপে অবাধে আহরণ হচ্ছে শামুক—ঝিনুক—পাথর। যার যেভাবে ইচ্ছা দ্বীপের সব স্থানে ঘুরছেন। পুরো এলাকা যেন নিয়ন্ত্রণহীন।

এদিকে ২০৪৫ সালের মধ্যে দ্বীপটি পুরোপুরি প্রবালশূন্য হতে পারে এমন আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে আন্তর্জাতিক ওশান সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে। এই দ্বীপে প্রবাল ছাড়াও রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় জলপাই রঙের কচ্ছপ, চার প্রজাতির ডলফিন, বিপন্ন প্রজাতির পাখিসহ নানান ধরনের প্রাণী।

দ্বীপের বাসিন্দারা জানান, পর্যটন মৌসুমকে সামনে রেখে দ্বীপে তাড়াহুড়া করে চলছে নতুন আবাসিক হোটেল নির্মাণের কাজ। রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি, পরিবেশ অধিদপ্তর, প্রশাসনসহ সরকারি কিছু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) সেন্টমার্টিন দ্বীপে এসব স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে। এই চক্রের যোগসাজশে প্রকাশ্যে টেকনাফ থেকে প্রায় ৩৪ কিলোমিটারের সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইট, লোহা, সিমেন্ট, বালুসহ যাবতীয় নির্মাণ সামগ্রী পৌঁছে যায় সেন্টমার্টিন দ্বীপে। সংশ্নিষ্ট দফতর ম্যানেজ থাকায় এসব নির্মাণসামগ্রী নির্বিঘ্নে নির্মাণস্থলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কোনো বাধা ছাড়াই গড়ে উঠছে হোটেল, কটেজ ও রেস্তোরাঁ। আবার অনেক সময় দ্বীপের তিন দিকে ছড়িয়ে থাকা প্রাকৃতিক পাথর ব্যবহৃত হচ্ছে অবকাঠামো তৈরিতে।

সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দায়ের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে দ্বীপে পাকা স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ এবং নির্মিত সব স্থাপনা উচ্ছেদ করতে সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এ দ্বীপকে ‘পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা করেন আদালত। আপিল বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী, সেন্টমার্টিনে ছোট-বড় কোনো স্থাপনাই নির্মাণের সুযোগ নেই। কিন্তু তারপরও সেখানে গড়ে উঠছে একের পর এক স্থাপনা। দ্বীপে রাস্তাসহ বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের নামে নিয়ে যাওয়া ইট, বালু, সিমেন্ট, কংক্রিট দিয়ে সেখানে নতুন করে অবৈধভাবে গড়ে উঠছে অর্ধশতাধিক ছোট—বড় আবাসিক হোটেল ও কটেজ।

আরও পড়ুন: পাহাড়ে পাহাড়ে বাণিজ্য, মরণফাঁদের ‘টার্গেট’ আলম-আমিনরাই

এ দ্বীপেই গড়ে উঠছে আবাসিক হোটেল ‘নিঝুম বাড়ি’। নির্মাণের দায়িত্বে থাকা হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘দ্বীপে ফাইভ স্টার হোটেলসহ অনেক দালানকোঠার নির্মাণকাজ চলছে। দ্বীপে শুধু আমি একা নির্মাণ করছি না, আরও অনেকে দালান নির্মাণ করছেন। বিশাল ভবন নির্মাণ হয়েছে তাতে দ্বীপের ক্ষতি হচ্ছে না, সামান্য এ দালানকোঠা নির্মাণে কী আর ক্ষতি হবে।’

আবার পূর্বপাড়া দালানকোঠা নির্মাণকারী মো. আলমের বক্তব্য— দ্বীপে দেড় শতাধিক ছোট-বড় আবাসিক হোটেল রয়েছে। এর মাঝেও অনেকে কটেজ নির্মাণ চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা তো কেউ অনুমতি নেননি। তাদের মতো আমি একটি ছোট কটেজ নির্মাণ করছি। এখানে অনুমতির কী আছে?’

যোগাযোগ করা হলে কোস্টগার্ড সেন্টমার্টিন স্টেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, অনুমতি ছাড়া কাউকে এখানে দালানকোঠা নির্মাণের জন্য মালপত্র আনতে দেওয়া হচ্ছে না। অনুমতি ছাড়া কোনো মালপত্র পেলে সেগুলো জব্দ করা হচ্ছে।

এদিকে সেন্টমার্টিনে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ১০৪টি আবাসিক হোটেল ভাঙার নির্দেশনার মধ্যেই নতুন করে ভবন নির্মাণ ‘দুঃখজনক’ বলে মন্তব্য করেন কক্সবাজারের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) প্রধান নির্বাহী এম ইব্রাহিম খলিল মামুন। তিনি আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে প্রভাবশালীরা আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে দিনদুপুরে নতুন ভবনের নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার পাশপাশি দ্রুত আদালতের নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। তা না হলে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন।

এসি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!