ঋণ নিয়ে টাকা মেরে খাচ্ছে ২৫ সমিতি, অসহায় বিআরডিবি

২৫টি সমিতির কাছ থেকে ঋণের ৩৬ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) মিরসরাই উপজেলা শাখার।

কৃষি ঋণ কর্মসূচির আওতায় ১৫টি সমিতি ও সদাবিক কর্মসূচির আওতায় ১০টি দলের কাছে বিতরণ করা ঋণের মোট ৩৬ লাখ ৭৪ হাজার ৮৮৯ টাকা দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া রয়েছে।

সমিতিগুলোকে ঋণখেলাপি ঘোষণা করে ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য একাধিক নোটিশ দিলেও তারা টাকা পরিশোধ করছে না। এসব সমিতির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা চেয়ে লিখিত আবেদন করে দুইবার মিরসরাই থানায় চিঠি দেওয়া হলেও কোনো ধরনের আইনি সহায়তা পাওয়া যায়নি।

জানা যায়, উপজেলায় মূল কর্মসূচি উপজেলা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি প্রকল্পে ১০৮টি, মুক্তিযোদ্ধা প্রকল্প ব্যক্তি পর্যায়ে ও সমন্বিত দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচি প্রকল্পে ৩৩টি সমিতি, পল্লী প্রগতি প্রকল্পে ১২টি সমিতি, আদর্শগ্রাম প্রকল্পে ১টি সমিতি ও অপ্রদান শস্য প্রকল্পে ৪টি সমিতি রয়েছে। সমিতিগুলোর কাছ থেকে সরকার প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা পাবে। মূলত জনবল সংকটের কারণে সমিতির টাকা সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। উপজেলার বিআরডিবি অফিসে বিভিন্ন প্রকল্পে ৯ জন মাঠ পর্যায়ের কর্মচারী কাজ করার কথা থাকলেও রয়েছেন মাত্র ২ জন।

এছাড়া প্রকল্পগুলোতে কর্মরত কর্মীদের সরকারি কোনো বেতন নেই। মূলত প্রকল্পে সরকারি বিনিয়োগকৃত ঋণের টাকার আদায় করা সুদ থেকে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের বেতন দেওয়া হয়। ফলে অনেক প্রকল্প থেকে ঋণের টাকা যথাসময়ে আদায় না হওয়ায় কিছুদিন পর এসব কর্মী চাকরি ছেড়ে চলে যান। দেশের ব্যাংকগুলোতে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিট করার নির্দেশনা থাকলেও বিআরডিবি এখনো ১১% সুদ নিচ্ছে। ফলে বিভিন্ন উদ্যোক্তা ও কৃষকরা সরকারি এই সুবিধা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।

উপজেলা পল্লী উন্নয়ন অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ১৫টি সমিতির কাছে ৪৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়। তাদের মোট বকেয়া রয়েছে ৩০ লাখ ৬৭ হাজার ৩৫ টাকা। এছাড়া সদাবিক কর্মসূচির আওতায় উপজেলার দশটি দলকে ১৫ লাখ ৩১ হাজার টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়। তাদের কাছে মোট বকেয়া রয়েছে ৬ লাখ ৭ হাজার ৮৫৪ টাকা।

ঋণখেলাপি সমিতি

কৃষি ঋণ কর্মসূচির আওতায় মান্দারবাড়িয়া কেএসএস লিমিটেড সমিতিকে ২০১৪ সালের ৭ এপ্রিল ৩ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়। তাদের কাছে এখন পর্যন্ত বকেয়া রয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। হরিহরপুর কেএসএস লিমিটেড সমিতিকে ২০০৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ৪ লাখ টাকা দেওয়া হয়। তাদের বকেয়া ৮৪ হাজার ৫০০ টাকা। মহামায়া কেএসএস লিমিটেড সমিতিকে ২০১০ সালের ২২ নভেম্বর দেওয়া হয় ২ লাখ ৮২ হাজার টাকা, তাদের বকেয়া ২ লাখ ৪ হাজার ৭০০ টাকা। আজমপুর কেএসএস লিমিটেড সমিতিকে ২০০৯ সালের ২৯ জুন দেওয়া হয় ১ লাখ ৯৪ হাজার টাকা, তাদের বকেয়া ৭৭ হাজার ৫০০ টাকা। মিঠাছড়া কেএসএস লিমিটেড সমিতিকে ২০০৯ সালে ১০ মে ৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়, এখন পর্যন্ত বকেয়া ৩ লাখ ৬ হাজার ৮০০ টাকা। মধ্যম মঘাদিয়া কেএসএস লিমিটেড সমিতিকে ২০০৫ সালের ১৪ আগস্টে দেওয়া হয় ৩ লাখ টাকা। তাদের বকেয়া ৪৬ হাজার ৬০০ টাকা। মধ্যম দুর্গাপুর কেএসএস লিমিটেড সমিতিকে ২০০৭ সালের ১ জুলাই দেওয়া ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকার বিপরীতে বকেয়া রয়েছে ২ লাখ ৯ হাজার ১৪০ টাকা। আরব আলীগ্রাম কেএসএস লিমিটেড সমিতিকে ২০০৯ সালে ১৭ আগস্টে দেওয়া ২ লাখ ৬০ হাজার টাকার বিপরীতে বকেয়া রয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা।

এছাড়া ধুমগ্রাম কেএসএস লিমিটেড সমিতিকে ২০১০ সালে ২৫ আগস্ট দেওয়া ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকার বিপরীতে বকেয়া ১ লাখ ৮০ হাজার ৭৪৩ টাকা, মিরসরাই বিএসএস লিমিটেড সমিতিকে ২০০৯ সালের ২৭ জুলাইয়ে দেওয়া ২ লাখ ১০ হাজার টাকা ঋণের বিপরীতে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৫৫২ টাকা, ডোমখালী কেএসএস লিমিটেড সমিতিকে ২০১৫ সালের ৭ নভেম্বরে দেওয়া ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকার ঋণের বিপরীতে ২১ হাজার ৫০০ টাকা, বাঁশখালী কেএসএস লিমিটেড সমিতির ২০১৮ সালে ৫ মার্চের ৯০ হাজার টাকা ঋণের বিপরীতে ৮৫ হাজার টাকা, মধ্যম সোনাপাহাড় কেএসএস লিমিটেড সমিতিকে ২০১৮ সালের ১৬ এপ্রিল দেওয়া ৩ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ঋণের পুরোটাই বকেয়া, পূর্ব ধূম কেএএস সমিতিকে ২০১৯ সালের ২৪ জানুয়ারিতে দেওয়া ৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা ঋণের বিপরীতে পুরোটা, পশ্চিম খইয়াছড়া মীর্জাপাড়া কেএসএস সমিতিকে ২০১৯ সালের ১৫ জানুয়ারিতে দেওয়া ৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ঋণের বিপরীতে ৪ লাখ ৬৭ হাজার টাকা বকেয়া রয়েছে।

ঋণখেলাপি সদাবিক দল

সদাবিক কর্মসূচির আওতায় পূর্ব মঘাদিয়া সদাবিক মহিলা দলকে ২০০৭ সালের ৫ আগস্ট দেওয়া ১ লাখ ৩৮ হাজার টাকা ঋণের বিপরীতে বকেয়া ২১ হাজার ৯৭০ টাকা, দক্ষিণ আমবাড়িয়া সদাবিক মহিলা দলকে ২০০৭ সালের ১০ ডিসেম্বর দেওয়া ৯৫ হাজার টাকা ঋণের বিপরীতে ১৭ হাজার ২০০ টাকা, চরশরৎ সদাবিক মহিলা দলকে ২০০৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দেওয়া ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার বিপরীতে  ১ লাখ ২৯ হাজার টাকা, ছোট কমলদহ সদাবিক মহিলা দলকে ২০১০ সালের ৯ জুলাই দেওয়া ১ লাখ ২০ হাজার টাকার বিপরীতে ৩২ হাজার ১৩০ টাকা, পশ্চিম চরশরৎ সদাবিক মহিলা দলকে ২০০৬ সালের ২৮ মে দেওয়া ১ লাখ ৮০ হাজার টাকার বিপরীতে ৮৮ হাজার ৭০০ টাকা, পূর্ব চরশরৎ সদাবিক মহিলা দলকে ২০০৪ সালের ৯ ডিসেম্বর দেওয়া ৩৫ হাজার টাকার বিপরীতে ২০ হাজার ৬৫০ টাকা, গোভনীয়া পুরুষ দলকে ২০০৪ সালের ৯ এপ্রিল দেওয়া  ১ লাখ ৪৭ হাজার টাকার বিপরীতে ১ লাখ ৬ হাজার ৭৫২ টাকা, নাহেরপুর পুরুষ দলকে ২০০৫ সালের ৫ জানুয়ারি দেওয়া ১ লাখ ৫৬ হাজার টাকার বিপরীতে ১৬ হাজার ৭৯০ টাকা, চরশরৎ সদাবিক মহিলা দলকে ২০০৪ সালের ২ জানুয়ারি দেওয়া ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার বিপরীতে ১ লাখ ২৯ হাজার ৬৬২ টাকা এবং পশ্চিম মঘাদিয়া শীলপাড়া মহিলা দলকে ২০১৫ সালের ২৬ মে দেওয়া ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা ঋণের বিপরীতে বকেয়া আছে ৪৫ হাজার টাকা।

কর্মকর্তা বললেন…

উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা মনসুর আহমদ তালুকদার আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, উপজেলায় কৃষি ঋণ কর্মসূচির আওতায় ১৫টি সমিতি ও সদাবিক কর্মসূচির আওতায় ১০টি দলের কাছে বিতরণ করা ঋণের মোট ৩৬ লাখ ৭৪ হাজার ৮৮৯ টাকা দীর্ঘদিন বকেয়া রয়ে গেছে। সমিতিগুলোকে ঋণখেলাপি ঘোষণা করে টাকা পরিশোধের জন্য একাধিক নোটিশ দিলেও তারা টাকা পরিশোধ করছে না। সমিতিগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য গত ৩১ জানুয়ারি উপজেলার মাসিক সমন্বয় সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যেখানে মিরসরাইয়ের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনও উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীতে সমিতিগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মিরসরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বরাবর গত ৩ মার্চ লিখিত আবেদন করা হয়। এর আগেও বেশ কয়েকবার লিখিত আবেদন করা হয়। তবে এখান পর্যন্ত কোনো আইনি সহায়তা পাওয়া যায়নি।

তিনি আরো বলেন, উপজেলার বিভিন্ন সমিতির কাছে বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে। মাঠ পর্যায়ের কর্মী সংকট, কর্মীদের বেতনের নিশ্চয়তা না থাকায় ঋণের টাকা যথাসময়ে আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না।

৮ বছর ধরে উপজেলায় মাঠ সহকারী ও মাঠ সংগঠকের পদ শূন্য রয়েছে বলেও জানান তিনি।

এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মিরসরাই থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মজিবুর রহমান আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, উপজেলার বিভিন্ন সমিতির কাছে টাকা পাওয়ার বিষয়টি আমাকে মৌখিকভাবে জানিয়েছিল পল্লী উন্নয়ন বোর্ড। যারা ঋণখেলাপি হয়েছে তাদের থেকে আপোষে নয়, আইনি ব্যবস্থা নিয়ে টাকা আদায় করতে হবে।

ডিসি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!