১০ হাজার মানুষের কান্নার স্লুইসগেট, রাত হলে নৌকা নেই—চিকিৎসা সংকটও প্রকট

আনোয়ারায় দুর্নীতির কারণে আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত স্লুইসগেট বছর যেতে না যেতেই পানির ভেতর তলিয়ে গেছে। পানির স্রোতে খালে বিলীন হয়ে গেছে প্রায় ১০০ মিটার বেড়িবাঁধও। এতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন প্রায় ১০ হাজার মানুষ।

এদিকে স্লুইসগেট তলিয়ে যাওয়ায় চাষাবাদ করতে না পারা কৃষকরা ভীষণ ক্ষতির মুখে পড়েছেন। আবার রাতে অসুস্থ হয়ে পড়া ব্যক্তিরা মারা যাচ্ছেন চিকিৎসা না পেয়ে!

একদিকে আনোয়ার উপজেলা, অন্যদিকে পটিয়া উপজেলা। একটি স্লুইসগেটের মাধ্যমে দুউপজেলাকে সংযুক্ত করেছে বাকখাইন ও কৈখাইন নামের দুগ্রাম।

এদিকে ইছামতি খালের শাখা দক্ষিণ বাকখাইন নোয়ারাস্তা কান্দুরিয়া খালের ওপর নির্মিত স্লুইসগেটটি বছর না যেতেই খালের ভেতর তলিয়ে যায়। স্লুইসগেটসহ ১০০ মিটারের বেড়িবাঁধ তলিয়ে যাওয়ার কারণে মানবেতর জীবনযাপন করছেন বিভিন্ন গ্রামের ১০ হাজার মানুষ।

পটিয়ার বাকখাইন গ্রামের বাসিন্দা মিনু বালা দাস। তিনি আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, আমরা চার মাস ধরে বন্দী হয়ে আছি। দুর্ভোগে চলছে এখানকার মানুষের জীবনে। অধিকাংশ মানুষ গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে। স্লুইসগেটসহ বেড়িবাঁধ ভাঙতে ভাঙতে বিলীন হয়ে গেছে। কয়েক মাস ধরে পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। যাতায়াতে আমাদের প্রচুর সমস্যা হচ্ছে। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যেতে পারছে না। গর্ভবর্তী মহিলা এবং গুরুতর অসুস্থ রোগীকে নিয়ে বেশ কষ্ট হচ্ছে। এর মধ্যে অসুস্থ হয়ে নৌকা না পেয়ে চিকিৎসার অভাবে বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে নৌকা। দিনে কোনোমতে পার হলেও রাত ১০টার পর নৌকা চলাচল করে না। রাতে কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে চেষ্টা করেও হাসপাতালে নিতে পারছি না। আবার দিনের বেলা খালের মধ্যে ভাটা হলে হাঁটু পরিমাণ কাদাতে নেমে কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে অসুস্থ রোগীকে নৌকায় তুলে পারাপার করতে হচ্ছে।

একই গ্রামের স্থানীয় আরেক বাসিন্দা মানিক ঘোষ বলেন, এলাকাবাসীর উদ্যোগে ১৫ হাজার টাকা খরচ করে চলাচলের জন্য বাঁশের সাঁকো দিলেও প্রবল স্রোতের বেগে ১০ দিনও টেকেনি। স্রোতের তোড়ে ভেঙে গেছে সাঁকো। যাতায়াতের ভোগান্তির কারণে অর্ধেক মানুষ এলাকা ছেড়ে অন্য জায়গায় ভাড়া বাসায় চলে গেছে।

জানা যায়, আনোয়ারা উপজেলার ইছামতি খালের শাখা দক্ষিণ বাকখাইন নোয়ারাস্তা কান্দুরিয়া খালের ওপর আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত স্লুইসগেটটি বছর যেতে না যেতেই পানির ভেতর তলিয়ে যায়। এছাড়া জোয়ারের পানির স্রোতে খালে বিলীন হয়ে গেছে প্রায় ১০০ মিটার বেড়িবাঁধ। নির্মাণের এক বছরের মধ্যে স্লুইসগেটটি পানিতে তলিয়ে গেলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড খবর নিচ্ছে না। এতে দুবছর ধরে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বাকখাইন গ্রামের বাসিন্দারা।

বাকখাইন গ্রাম ছাড়াও চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে আশপাশের আরো বেশ কয়েক গ্রামের হাজার হাজার বাসিন্দাকে। স্লুইসগেটটি বিলীন হওয়ায় উপজেলার চাতরী, পরৈকোড়া, বারখাইন, আনোয়ারা সদরসহ চারটি ইউনিয়নের হাজার হাজার একর জমির ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।

স্থানীয়রা বলছেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে স্রুইসগেট বেড়িবাঁধসহ খালে বিলীন হয়ে গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ এই পয়েন্টে টেকসই বাঁধ নির্মাণ না করা এবং স্লুইসগেটের উভয় পাশে ব্লকসহ যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় এটি বিলীন হয়ে গেছে।

সরেজমিন দেখা যায়, স্লুইসগেটসহ প্রায় ১০০ মিটার বেড়িবাঁধ পুরোপুরি খালে বিলীন হয়ে গেছে। নৌকা নিয়ে পারাপার হচ্ছে স্থানীয় লোকজন। বালুভর্তি জিওব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

স্থানীয় কৃষকরা জানান, ভাঙা অংশ দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করার কারণে এখানে হাজার হাজার একর জায়গায় কোনো চাষাবাদ করা যাচ্ছে না। অন্যান্য সময় এ মৌসুমে ধান রোপন, মরিচ ও শীতকালীন বিভিন্ন শাকসবজি চাষ করলেও এ মৌসুমে সবাই বেকার বসে আছেন। আয় না থাকায় সংসার চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

পার্শ্ববর্তী মহতরপাড়া এলাকার বাসিন্দারা বলেন, কুমারখালি খালের ওপর নিমির্ত স্রুইসগেটে ফাটল দেখা দিলে সিমেন্ট দিয়ে আস্তর করে দেয় যাতে ফাটল দেখা না যায়। ইছামতি থেকে মহতরপাড়া পেশকার হাট পর্যন্ত সাড়ে ১৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। বিশেষ করে মহতরপাড়া এলাকায় জমির আইলের মতো করে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে গেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। নির্মাণের ৪-৫ মাস না যেতেই অনেক অংশে ভেঙে গেছে নির্মাণাধীন এ বেড়িবাঁধ। বেড়িবাঁধ নির্মাণে ঠিকাদারের ভূমিকা পালন করছেন পাওবো কর্মকর্তা।

যোগাযোগ করা হলে আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ জোবায়ের আহমেদ আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, স্লুইসগেটটি তলিয়ে যাওয়ায় চাষাবাদে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। আমরা স্লুইসগেটটি দ্রুত নির্মাণ করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানিয়েছি।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের আনোয়ারার কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, নির্বাহী প্রকৌশলীরা এটি তদরকি করছেন। শিগগির এটি নতুনভাবে নির্মাণ হবে।

এসআই/আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!