ভোর হলেই স্বপ্নের ফাইনাল, আর্জেন্টিনা নাকি ব্রাজিল—এগিয়ে যে

মেসি নাকি নেইমার— রিও ডি জেনেরিওর মারাকানা স্টেডিয়ামে কে পাবেন শিরোপার অমৃত স্বাদ?

এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে রোববার (১১ জুলাই) ভোর ৬টা পর্যন্ত।

তবে কোপার এই স্বপ্নের ফাইনালে দীর্ঘ আক্ষেপ ঘোচানোর আরেকটি সুযোগ এসেছে আর্জেন্টিনার সামনে। ১৯৯৩ সালের পর শিরোপা জিততে ভুলেই গিয়েছে লা আলবিসেলেস্তেরা। তাদের সামনে সুযোগ যে আসেনি তা নয়, কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি।

এরপর আরো চারটি ফাইনাল খেলেছে আর্জেন্টিনা। কিন্তু রানার্সআপের ট্রফি নিয়ে তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৯ আসরে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের কাছে হেরে শেষ চারের লড়াই থেকে বিদায় নিতে হয় তাদের। সেইবার তৃতীয় স্থান নিয়ে ঘরে ফেরে তারা।

দলের মতো মেসির মনেও একই আক্ষেপ। শিরোপার পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও তুলে  নিতে পারেননি হাতে। এটি মেসির ষষ্ঠ কোপা আসর। এর আগের পাঁচবারের তিনবার অধিনায়কত্বও করেছিলেন এ স্ট্রাইকার। তার নেতৃত্বে চতুর্থবারের মতো কোপায় খেলছে আর্জেন্টিনা।

মেসির মতো নেইমারেরও একই আক্ষেপের সুর। গত আসরে তার দল শিরোপা জিতলেও উদযাপনে সঙ্গী হতে পারেন তিনি। তাই এই ফাইনাল নেইমারের জন্যও ‘মহারণ’।

শিরোপা-খরা কাটানোর এরচেয়ে ভালো সুযোগ বোধহয় আর পাবেন না লিওনেল মেসি। তবে আর্জেন্টিনা দল মেসিনির্ভর। যোগ্য সঙ্গীর অভাবে বারবার মাঠে মারা যান এ বার্সা তারকা। তাকে ঠিকভাবে অ্যাসিস্ট করতে পারেন না সতীর্থরা। আর্জেন্টিনার মাঝমাঠ ও রক্ষণভাগ মাঝারি মানের। কোচ স্কালোনি ফাইনালেও হয়তো ৪-৩-৩ ফরমেশনে খেলাবেন তার শিষ্যদের।

লাওতারো মার্টিনেজকে হয়তো মূল স্ট্রাইকার হিসেবে দেখা যাবে রোববার। আর তার রাইট উইং মেসি ও লেফট উইংয়ে থাকতে পারেন গঞ্জালেস অথবা পাপু গোমেজ। মাঝমাঠে তালিয়াফিকো, রদ্রিগেজ, সেলসো ও দি পল থেকে যেকোনো তিনজন থাকতে পারেন। কিন্তু তাদের ‍মূল সমস্যার জায়গা রক্ষণভাগ। এত বছরেও উন্নতি হয়নি এই বিভাগে। রক্ষণে তাদের ভরসার প্রতীক রোমেরোর খেলাও অনিশ্চিত। গত ম্যাচে তিনি আহত হয়েছিলেন। তাই ওটামেন্দি ও পেৎসায়াকে দেখা যেতে পারে রক্ষণ সামলানোর দায়িত্বে। আর তাদের দুই পাশে আকুমন্দি এবং মন্তিয়েল না হয় মলিনা থাকবেন।

তবে যেই থাকুক মেসি অন্যদের অ্যাসিস্ট করলেও তাকে অ্যাসিস্ট করার মতো যোগ্য কেউ নেই। তাই হয়তো বেগ পেতে হতে মাঠে। আর মেসি ছাড়া ড্রিবলিং ও ক্ষুরধার আক্রমণও তেমন নেই কারো।

মাঠের ১০ জন ছাড়াও সবার চোখ গোলরক্ষক মার্তিনেজের দিকে থাকবে। কলম্বিয়ার ম্যাচের মতো ‘দেয়াল’ হয়ে ব্রাজিলের ক্ষিপ্র আক্রমণ যদি তিনি রুখে দিতে পারেন তাহলে হয়তো শিরোপা জয়ের স্বপ্ন সত্যি হতে পারে মেসি বাহিনীর।

তবে আর্জেন্টিনার রক্ষণ যতটা দুর্বল ঠিক ততটা শক্ত ব্রাজিলের আক্রমণ। বলতে গেলে গতির লড়াইয়ে তারা আর্জেন্টিনার চেয়ে অনেক এগিয়ে। নেইমারের ড্রিবলিং, ক্ষুরধার আক্রমণের সঙ্গে রয়েছে গতির মিশ্রণ। আর ফাইনালে সবচেয়ে যেটা কার্যকরী ঔষধি হিসেবে কাজে দেবে। সঠিক অ্যাসিস্ট পেলে দিনটি নিজের করে নিতে কোনো অসুবিধা হবে না নেইমারের।

সেলেকাওদের কোচ তিতে ফাইনালে ফরমেশনটা কেমন করেন সেটাই দেখার বিষয়। শিষ্যদের ৪-২-৩-১ ছকে খেলালেও প্রথমার্ধের পর হয়তো পাল্টে ফেলতে পারেন এটি।

ফরমেশন যেটাই হোক মেসিকে আটকাতে হলে রক্ষণে চারজন দাঁড়াতে হবে। এ বিভাগে থিয়াগো সিলভার সঙ্গে মার্কিনিওস থাকবেন। সেই সঙ্গে রাইট ও লেফট ব্যাকে দানিলো এবং লোদি সঙ্গ দেবেন তাদের। মাঝমাঠে মেসিদের আটকাতে ফেড্রের সঙ্গে কাসেমিরো থাকবেন। এ দু’জন আবার উপরে উঠেও খেলতে পারদর্শী। অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে থাকবেন লুকাস পাকেতা। পেরুর বিরুদ্ধে তার গোলেই ফাইনাল নিশ্চিত করে ব্রাজিল। তাদের জিসুস না থাকায় হয়তো খানিকটা বেগ পেতে হবে। সেক্ষেত্রে যদি রাইটে এভারটন ও লেফট উইংয়ে নেইমার খেলেন তাহলে স্ট্রাইকার হিসেবে থাকবেন ফিরিমিনো। গোলবারের নিচে এডারসন থাকবেন প্রতিপক্ষের আক্রমণে ঠেকানোর দায়িত্বে।

এখনো পর্যন্ত এবারের আসরে ৪ গোল করে মেসি সর্বোচ্চ গোলদাতা। সেই সঙ্গে অ্যাসিস্ট করেছেন ৫টি গোলে। ৩ গোল করেছেন নেইমার, করিয়েছেনও ৩টি।

কোপার ৪৭তম ট্রফি যার হাতের শোভা বাড়াবে রেকর্ডের খাতায় তিনি দুই কিংবদন্তি পেলে-ম্যারাডোনাকে ছাড়িয়ে যাবেন। পেলে একবার ও ম্যারাডোনা দুইবার নেমেছিল কোপার লড়াইয়ে। কিন্তু তারা হাতে তুলতে পারেননি এই ট্রফি।

কোপা পরিসংখ্যান

আর্জেন্টিনা ১৪ বার শিরোপা জিতেছে। সমানসংখ্যক রানার্সআপ ট্রফিও আছে তাদের ঘরে। কোপায় এটি তাদের ৪৩তম অংশগ্রহণ। এ পর্যন্ত তারা ম্যাচ খেলেছে ২০১টি। জিতেছে ১২৭ আর হেরেছে ৩৩টি। ড্র করেছে ৪১ ম্যাচ। গোল করেছে ৪৭৩ আর হজম করেছে ১৮২টি। কোপার প্রথম আসরের রানার্সআপও তারা। তাদের প্রথম ট্রফি ঘরে এসেছিল ১৯২১ সালে। তবে এ টুর্নামেন্টের চার আসর খেলেনি তারা। ১৯৩৯, ১৯৪৯, ১৯৫৩ ও ২০০১ সালে নাম প্রত্যাহার করেছিল আলবিসেলেস্তেরা।

ব্রাজিলের এটি ৩৭তম অংশগ্রহণ। তারা শিরোপা ঘরে তুলেছে ৯ বার। রানার্সআপ হয়েছে ১১ আসরে। গত আসরের চ্যাম্পিয়নরা প্রথম ট্রফি জিতেছিল ১৯১৯ সালে। এ পর্যন্ত তারা ১৯৬ ম্যাচ খেলে জিতেছে ১১৩টি ও হেরেছে ৪৪টি। ড্র করেছে ৩৯ ম্যাচ। গোল করেছে ৪৪২টি ও খেয়েছে ২০৫টি। এ টুর্নামেন্ট থেকে তারাও সর্বোচ্চ ১০ বার নাম প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯২৪, ১৯২৬ থেকে ১৯৩৫ পর্যন্ত চার আসর, ১৯৩৯, ১৯৪১, ১৯৪৭, ১৯৫৫ ও ১৯৬৭ সালে খেলেনি সেলেকাওরা।

মুখোমুখি

কোপার পরিসংখ্যান আর্জেন্টিনাকেই এগিয়ে রাখছে। এর আগে ৩৩ বার সাক্ষাত হয়েছিল দু’দলের। এরমধ্যে আর্জেন্টিনা ১৫ ও ব্রাজিল ১০ ম্যাচ জিতেছে। ড্র হয়েছে ৮ ম্যাচ। আর্জেন্টিনা গোল করেছিল ৫২টি আর ব্রাজিল ৪০টি। ২০০৪ ও ২০০৭ আসরে ফাইনালে ব্রাজিলের কাছে হেরেই আর্জেন্টিনার স্বপ্নভঙ্গ হয়। ২০১৯ সালের সেমিফাইনালের পর এবার তৃতীয়বারের মতো ফাইনালে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে তারা। এবারের আসরে এখনো অপরাজিত আছে দু’দল।

আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এগিয়ে আছে ব্রাজিল। ১০৭ বার মুখোমুখি লড়াইয়ে তারা আর্জেন্টিনাকে হারিয়েছে ৪২ বার। নিজেরা হেরেছে ৩৯ বার। ড্র হয়েছে ২৬ ম্যাচ। ব্রাজিল করেছে ১৬৬ গোল ও আর্জেন্টিনা ১৬১টি।

লড়াইটা আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল হোক অথবা মেসি-নেইমারের, পুরো বিশ্ব লাতিন ফুটবলের এক ধ্রুপদ লড়াইয়ের প্রত্যাশায় থাকবে। এই লড়াইয়ে মেসির বাঁ পায়ের জাদু ও নেইমারের ড্রিবলিং হাজার মাইল দূরে থাকা বাঙালিদের স্নায়ুচাপও বাড়াবে কয়েকগুণ।

যার হাতেই শিরোপা উঠুক—বাংলাদেশও উদযাপনে মেতে উঠবে কোপা আমেরিকা জয়ের আনন্দে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!