বেপরোয়া কিশোর গ্যাং—বাড়ছে খুন, আসামিদের বেশিরভাগই কিশোর

কর্ণফুলীতে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেছে কিশোর গ্যাং। গত পাঁচ বছরে এ উপজেলায় ৯টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এসব খুনের ঘটনায় আসামিদের বেশিরভাগই কিশোর!

সচেতন মহল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইন না মানার প্রবণতা, কিশোর অপরাধে আধিপত্য বিস্তার ও মাদক সেবনের কারণেই এসব খুনের ঘটনা ঘটেছে। এখানকার অনেক এলাকায় কিশোররা এখন বেপরোয়া। পাড়া-মহল্লায় আতঙ্কের কারণ এই কিশোর গ্যাং।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কিশোর গ্যাং সদস্যদের অনেক অভিভাবক প্রভাবশালী। কেউ কেউ আবার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ফলে অপরাধ করলেও কেউই তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস করে না।

এদিকে বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা ধরা পড়লেও তারা জামিনে বেরিয়ে আসে। মুক্ত হয়েই ফের জড়িয়ে পড়ে অপরাধে। স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব কিশোর জামিনে বের হলে অনেক নেতা জেল গেইটে তাদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেন। অথচ এই কিশোররাই ইভটিজিং থেকে শুরু করে চুরি, ছিনতাই, মাদক বিক্রি, অপহরণ, এমনকি খুনের সঙ্গেও জড়িত!

সূত্র জানায়, এলাকায় এলাকায় অপরাধ করে বেড়াচ্ছে কিশোর সন্ত্রাসীরা। এদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ স্থানীয় বাসিন্দারা। এসব কিশোরের কাছে রয়েছে রাম দা, ছুরি, চাপাতি, হকস্টিক, ককটেল, সুইচ গিয়ার নাইফ ছুরিসহ অসংখ্য অস্ত্র।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বড়উঠান ইউনিয়নে কিশোর গ্যাংয়ের এলোপাতাড়ি ধারালো অস্ত্রের কোপে ছাত্রলীগ নেতা মামুন আল রশিদ (২৪) খুন হন।

২০১৯ সালের ৫ মার্চ রাতে উপজেলার শিকলবাহা ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের আজম আলীর পুকুরপাড়ে ছুরিকাঘাতে খুন হন আজগর আলী (২৫)।

২০২০ সালের ১৮ জানুয়ারি শিকলবাহা এলাকায় দুবাই প্রবাসী রায়হানুল ইসলাম সজিবকে (২৫) গামছা পেঁচিয়ে খুন করা হয়।

একই বছরের ২৫ এপ্রিল সকালে চরলক্ষ্যার খুইদ্দারটেক এলাকায় ছুরিকাঘাতে আরিফ হোসেন দোভাষ (২০) খুন হন।

১৯ এপ্রিল আবার প্রেমঘটিত কারণে চরলক্ষ্যায় রাত ১০টার দিকে সংঘবদ্ধ কিশোরগ্যাংয়ের হাতে কবিরাজ সায়ের মোহাম্মদ সাগর (৩৮) খুন হন। পরে র‌্যাবের হাতের গ্রেপ্তার হয় ৬ কিশোর।

এর ৫ মাস পর ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় চরলক্ষ্যার মৌলভীবাজারে ছাত্রলীগ নেতা মো. সাহাবুদ্দিনকে (২৬) এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মারাত্মক জখম করা হয়। এছাড়া চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের সৈন্যেরটেকে কিশোর গ্যাং সদস্যরা দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ডিজে সৈকতের দোকানে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়।

২০২১ সালের ২৩ এপ্রিল ফেসবুক নিয়ে সৃষ্ট বিরোধে বোরহান উদ্দিন সোহান (১৭) নামে এক কিশোরকে ছুরিকাঘাত করে কিশোর গ্যাং।

একই বছরের ৩০ এপ্রিল কিশোর গ্যাং লিডার সোহেল দেশীয় অস্ত্র দিয়ে নিজাম উদ্দিন প্রকাশ মধু নামে এক যুবককে কুপিয়ে হাতের কব্জি আলাদা করে ফেলেন। মধুকে বাঁচাতে এগিয়ে এলে পথচারী আবদুস শুক্কুর (৬৮) ও তাঁর স্ত্রী রিজিয়া বেগম (৫৫) গুরুতর জখম করে সোহেল।

৩ মে রাতে উপজেলার চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় একই পরিবারের তিন সহোদর আহত হন। তারা হলেন- মো. ইউসুফ (৩৪), মো. ইসহাক (৩২) ও মো. ইলিয়াছ (৩০)।

২০২১ সালের ১৯ মে রাত ১০টায় চরলক্ষ্যা বোর্ড বাজার এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে খুন হন মো. মুরাদ। তলপেটে প্রচুর রক্তকরণ হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে তিনি মারা যান। ২৫ আগস্ট যানবাহনে ডাকাতি করার অপরাধে র‌্যাবের হাতে আটক হয় ৬ কিশোর যুবক। আটকদের শরীর তল্লাশি করে একটি এলজি, দুরাউন্ড গুলি, তিন রাউন্ড কার্তুজ ও চারটি ছুরি উদ্ধার করা হয়।

একই বছরের ১১ ডিসেম্বর রাত ১১টায় চরপাথরঘাটা এলাকায় সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে কথা কাটাকাটি হলে জাহাঙ্গীরের পেটে ছুরি চালিয়ে দেয় কিশোর গ্যাং নেতা রুবেল। ১৮ ডিসেম্বর তার মৃত্যু হয়।

২০২২ সালের ১৬ জুন রাতে কর্ণফুলী উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের উপপাঠাগার সম্পাদক বিষয়ক রমজান আলীকে (৩৭) ছুরিকাঘাতে খুন হন। চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের ইছানগর যুবক কলোনিতে এ ঘটনা ঘটে।

১০ আগস্ট সন্ধ্যা ৭টায় ফকিরনীর হাট কাঁচাবাজার এলাকায় পানি চলাচল নিয়ে বিরোধের জের ধরে মো. আনোয়ার (৩১) নামে এক যুবক ছুরিকাঘাতে খুন হন।

সর্বশেষ ২০২২ সালের ২ নভেম্বর রাতে খোয়াজনগরে ৪ যুবকের হামলায় রাম দা ও ছুরির কোপে গুরুতর আহত হন কবির মেম্বার বাড়ির নাজমুল হোসেন (২৬)। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়।

সূত্র জানায়, কিশোর গ্যাং সদস্যরা উপজেলার বড়উঠানের দক্ষিণ শাহমীরপুর, শিকলবাহার মাস্টারহাট, চরলক্ষ্যার মৌলভীবাজার, ইছানগর বিএফডিসি ও ডায়মন্ড, চরপাথরঘাটার খোয়াজনগর ও জুলধার পাইপের ঘোড়া বাজারে নানা অপরাধে জড়িত।

চরপাথরঘাটা কিশোর ও যুব গ্যাং প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক ইঞ্জি. ইসলাম আহমদ বলেন, এ বিষয়ে পরিবারের দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। প্রত্যেক অভিভাবকের উচিত ছেলে কোথায় যায়, কার সাথে মিশে, কী করে তার নজরে রাখা।

যোগাযোগ করা হলে কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. দুলাল মাহমুদ আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা ছোটখাটো অপরাধ করতে করতে বড় অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। তাই এদেরকে সংশোধন করতে সর্বপ্রথম অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। এরপরেও কেউ অপরাধ করলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

একই প্রসঙ্গে সিএমপি বন্দর জোনের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) শাকিলা সোলতানা বলেন, অভিভাবকদের খেয়াল রাখা উচিত তাদের সন্তান অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলোতে যাওয়া-আসা করছে কি-না। পুলিশ কিশোর অপরাধ দমনে সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে শুধু আইনের প্রয়োগ করে এ সমস্যার সমাধান করা সহজ নয়। এক্ষেত্রে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন বিষয় জড়িত। তাই আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিকভাবে এ বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করতে হবে।

আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!