বারবার আগুন দেওয়ার পরও ফিরে আসা পারিয়ালপাড়ার ক্ষেত্রপাল বিগ্রহ

দুদিনের আয়োজন শুরু আজ

রাউজানের পশ্চিম গুজরার পারিয়ালপাড়ায় রয়েছে ৫০০ বছরের পুরনো সর্বজনীন শ্রীশ্রী ক্ষেত্রপাল বিগ্রহ মন্দির। বছরে শুধু একবারই ভক্তরা দেখার সুযোগ পান ক্ষেত্রপাল বিগ্রহটি। যেটি দেখতে শিবের জটার মতো।

ঋতুরাজ বসন্তের শেষে মহাবিষুব সংক্রান্তির আগের দিন পুণ্যময় তিথিতে সন্ধ্যার পর ক্ষেত্রপাল বিগ্রহটি জনসমক্ষে আনা হয় ভক্তদের দেখার জন্য। পূজার আগের দিন রাতে মন্দির প্রাঙ্গণে উত্তোলন করা হয় ক্ষেত্রপাল বিগ্রহ। এসময় ভক্তের ঢল নামে বিগ্রহটি একবার দেখতে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার, বলিদান শুরু হলেই বিগ্রহটি নিজ থেকেই দক্ষিণ দিকে ঘুরে যায়!

জনশ্রুতি আছে, বছরান্তে ঠাকুর সংখ্যা গণনায় বাড়েও, আবার কমেও। এর বহু প্রমাণ রয়েছে। এছাড়া ক্ষেত্রপাল বিগ্রহের অলৌকিক অনেক ঘটনাও রয়েছে। একজন বোবা সন্তান ঠাকুরের কৃপায় মুখ ফুটে কথা বলার ঘটনাও রয়েছে এ মন্দিরে।

ভক্তদের বিশ্বাস, বিগ্রহের শ্রীচরণে ভক্তরা যা প্রার্থনা করেন তাই পান। অর্থাৎ অন্ধজনে পায় চক্ষু, দুঃখীজনে সুখ, নিঃসন্তান সন্তান পায় করে না বিমুখ।

প্রতিবছর শ্রীশ্রী ক্ষেত্রপাল বিগ্রহের পূজা উপলক্ষে দুদিনের নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে মন্দির কমিটি। এবারও এর ব্যতিক্রম নেই। ১২ ও ১৩ এপ্রিল (শুক্রবার ও শনিবার) মন্দিরে গীতাপাঠ ও প্রতিযোগিতা, ধর্মীয় সঙ্গীতানুষ্ঠান, মহাপ্রসাদ বিতরণ, চণ্ডীপাঠ, পূজাঅর্চনা, ঠাকুরের ভোগ, বলিদান ও নিলাম অনুষ্ঠানসহ রয়েছে নানা আয়োজন।

ক্ষেত্রপাল বিগ্রহ কী?

শিব পুরাণ মতে, দুর্গা দেবীর পিতা দক্ষ রাজা এক বিরাট যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। সেই যজ্ঞে তেত্রিশ কোটি দেবতা সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও মহাদেবকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। দেবর্ষি নারদ এ সংবাদ পৌঁছে দিলেন দেবী দুর্গাকে। দুর্গা এ অপমান সহ্য করতে না পেরে ক্রোধে দক্ষযজ্ঞে দেহত্যাগ করলেন। শিব তখন তাণ্ডব নৃত্য শুরু করলেন। স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল ত্রিভূবন কম্পিত হলো। সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে শিব মাথার জটা ছেড়ে দিয়ে উন্মাদ হয়ে উঠল। শিবের মাথার সেই জটাই হচ্ছে এই ক্ষেত্রপাল। এটা পঞ্চক্ষেত্রপাল।

পশ্চিম গুজরায় যেভাবে আবিভূত হয় ক্ষেত্রপাল বিগ্রহ  

প্রায় পাঁচশ বছর আগে ভারতের হরিদ্বার থেকে দুই যোগী ব্রাহ্মণ সহোদর এসেছিলেন চণ্ডীতীর্থ মেধস মুনির আশ্রম দর্শনে। সেই দুসহোদরের মধ্যে বড় ভাই হলেন নরসিংহ পারিয়াল এবং ছোট ভাই হরিশ সিংহ পারিয়াল। আশ্রম দেখে মুগ্ধ হয়ে তারা সেখানে চিরস্থায়ী বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। পরে বোয়ালখালীর সরোয়াতলী গ্রামে বসতি গড়েন।

ভ্রমণপিপাসু মহাসাধক নরসিংহ পারিয়াল প্রতিদিন হাতির পিঠে চড়ে ভ্রমণে যেতেন। একদিন ছোট ভাইয়ের সঙ্গে অভিমান করে চলে আসেন পশ্চিম গুজরায়। এরপর সেখানে তিনি বসতি স্থাপন করেন। পরে সেখানে  দৈবযোগে নরসিংহ পারিয়াল ক্ষেত্রপাল বিগ্রহটি পান। তখন থেকেই ডা. মনিন্দ্র নাথ পারিয়ালের গৃহমন্দিরে ক্ষেত্রপাল বিগহটি পূজিত হয়। পরবর্তীতে পারিয়াল বংশের এই গৃহদেবতা সর্বজনীন বিগ্রহে রূপ নিল এবং পূজার পরিসর ক্রমশ বাড়তে থাকল।

ক্ষেত্রপাল বিগ্রহের কিছু অলৌকিক ঘটনা 

অনেক বছর আগে ক্ষেত্রপাল বিগ্রহটি পারিয়াল বংশের মাটির ঘরের দোতলায় পূজিত হতো। হঠাৎ একদিন সেই ঘর আগুনে পুড়ে সবকিছু ছাই হয়ে গেল। এতে প্রাচীন বিগ্রহটি আর পাওয়া যাবে না বলে সবাই দুঃখ প্রকাশ করতে লাগল। কিন্তু সেই বিগ্রহটি চলে গেল মগদাই খালে। সেখানে এক জেলের মাছ ধরার জালে সেটি আটকা পড়ল। জেলে বিগ্রহটি চিনতে না পেরে নদীর তীরে রেখে আসেন। সেদিন রাতে সেই জেলেকে স্বপ্নে আদেশ করা হলো যেন ঢাক-ঢোল বাজিয়ে এখানে নিয়ে আসে।

১৯৭১ সালের ৪ বৈশাখ মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে ক্ষেত্রপাল বিগ্রহটি উঠানে দণ্ডায়মান ছিল। রাজাকার বাহিনী এসে পারিয়ালপাড়ার প্রতিটি ঘরে লুটপাটের পাশাপাশি আগুন ধরিয়ে দেয়। এমনকি পাঁচশ বছরের প্রাচীন বিগ্রহটিতেও আগুন ধরিয়ে দেয়। এসময় পূজারি রবীন্দ্রনাথ পারিয়াল বাঁধা দেন এবং বিগ্রহে আগুন না দেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু রাজাকার বাহিনী তাকে মারধর করে বিগ্রহটি পুড়িয়ে দেয়। এরপর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভক্তরা দুঃখ প্রকাশ করতে লাগলেন প্রাচীন বিগ্রহটি হয়ত আর পাওয়া যাবে না। কিন্তু এই ক্ষেত্রপাল বাঁশের অগ্রভাগ ভেজে বর্তমান মন্দির হতে পাঁচশ হাত দূরে পশ্চিম পাশে পড়ে গিয়েছিল। চৈত্র সংক্রান্তির কিছুদিন আগে ভক্তদের স্বপ্নে জানাল, আমি এখানে আছি, ঢাক-ঢোল বাজিয়ে তুলে নিয়ে আয়।

শ্রীশ্রী ক্ষেত্রপাল বিগ্রহ যে স্থানে উঠানো হয় সেখানে দুটি কাঠের পিঁড়ি দেওয়া হয়। এরমধ্যে পুরানো পিঁড়িটিতে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আগুন দেওয়া হলে সেটির কিছু অংশ পুড়ে যায়। পরবর্তী বছর নতুন আরেকটি পিঁড়ি তৈরি করে দেওয়া হয়। কিন্তু সেই বছর অনেক চেষ্টা করেও বিগ্রহটি তুলতে সবাই ব্যর্থ হয়। পরে পুনরায় পোড়া পিঁড়িটি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুর যথারীতি উঠে যায়। এছাড়া বলিদান শুরু হলে বিগ্রহটি আপনা-আপনি দক্ষিণ দিকে ঘুরে যায়। এ দুটি ঘটনা এখনও দেখা যায়।

২০০৮ সালে চট্টগ্রামের মাদারবাড়ি থেকে বোবা সন্তান নিয়ে মন্দিরে আসেন এক মুসলিম। ঠাকুরের কৃপায় সেই বোবা সন্তান এখানেই মুখ ফুটে কথা বলল। এ ধরনের ঘটনা আরও অনেক রয়েছে। বিগ্রহের শ্রীচরণে যা প্রার্থনা করেন তাই পান, এমনই বিশ্বাস ভক্তদের

যেভাবে যেতে হবে মন্দিরে

চট্টগ্রাম শহরে থেকে অটোরিকশায় অথবা কাপ্তাই রাস্তার মাথা থেকে লোকালে জনপ্রতি ২০ টাকা ভাড়ায় বরিয়াখালী গেইট। এরপর অটোরিকশা বা রিকশায় ২০ টাকা ভাড়ায় কেরানিহাট। সেখান থেকে একটু এগোলেই পারিয়ালপাড়া। এছাড়া বরিয়াখালী গেইট নেমে ৩০ মিনিট হাঁটলেই পারিয়ালপাড়ার শ্রীশ্রী ক্ষেত্রপাল বিগ্রহ মন্দির।

আরবি/আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!