চট্টগ্রামে চোরাই পণ্য মামলার আসামির রমরমা ব্যবসা, হাতিয়ার—নগর পুলিশের সঙ্গে চুুক্তি

মো. হুমায়ুন কবির, সবার চোখে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হলেও আড়ালে করেন চোরাই পণ্যের বাণিজ্য। এ নিয়ে দু-দুটো মামলাও আছে তাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু এরপরও কেউ তাঁর টিকিটিও ছুঁতে পারে না। কারণ চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) সঙ্গে যে রয়েছে তাঁর দারুণ সখ্যতা।

নির্বিঘ্নে বাণিজ্য চালাতে পুলিশের জায়গায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও আছে তাঁর। এজন্য সিএমপির সঙ্গে হয়েছে চুক্তিও। যে চুক্তিতে স্বাক্ষর রয়েছে খোদ সিএমপির এক সিনিয়র কর্মকর্তার!

আরও পড়ুন : পুলিশ খুঁজে দিল ব্যাংকারের হারিয়ে যাওয়া লাখ টাকা

পুলিশের সঙ্গে চুক্তিই এখন হাতিয়ার হুমায়ুনের। কথায় কথায় মানুষকে দেন পুলিশের হুমকি। আবার কেউ তাঁর অপকর্মের প্রতিবেদন করতে গেলে তাকেও ভয় দেখান পুলিশের। না, শুধু যে ভয় দেখান তা নয়। তাঁর ক্ষমতা যে কতটা এর প্রমাণও তিনি দেখান। তাঁর এক ইশারায় ফোন করেন পুলিশের বড় কর্তাও। আবার সিএমপির উচ্চ পর্যায়ের কয়েকজনের নাম ধরে তিনি দম্ভ করে বলেন- ওনারা সবাই তাঁর আত্মীয়।

সিএমপির জায়গার ওপরই চলছে ‘এস্টোরিয়ন’ নামে হুমায়ুনের বিশাল এক কাপড়ের শোরুম। এর ওপরে রয়েছে তাঁর হোটেল ব্যবসা। যার নাম গ্র্যান্ড মোগল রেস্টুরেন্ট। এই রেস্টুরেন্টের পাশেই রয়েছে সিএমপির ফুয়েল স্টেশন ও সিএমপির প্রধান কার্যালয়।

এসব ব্যবসা চালাতে নগরের ওয়াসা এলাকায় সিএমপির প্রধান কার্যালয়ের সামনেই তিনতলার একটা ভবন ভাড়া নেন হুমায়ুন। ভাড়া দিয়ে ব্যবসা চালাতে ইপিজেড থানার দুই মামলার আসামি হুমায়ুনের সঙ্গে চুক্তি করেন সিএমপির উপকমিশনার (সদর) আমির জাফর! সিএমপি কমিশনারের পক্ষে তিনি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এর চেয়ে বড় ব্যাপার, ভবনটি বানাতে গিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কোনো অনুমোদন নেওয়াও প্রয়োজন মনে করেনি পুলিশ।

আরও পড়ুন:ওষুধ চুরি—চট্টগ্রাম মেডিকেলের ওষুধ চোর ধরে পুরস্কার পেল পুলিশ 

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, হুমায়ুন কবিরের বিরুদ্ধে সিএমপির ইপিজেড থানায় চোরাই পণ্য বেচাকেনা ও মজুদের দুটি মামলা রয়েছে। ওই দুই মামলায় আসামির তালিকায় রয়েছে আরও কয়েকজনের নাম। মামলার পর পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে চোরাই পণ্য মজুদ ও বেচাকেনার চাঞ্চল্যকর তথ্য। যেখানে সর্বাগ্রে আসে হুমায়ুন কবিরের নাম।

এদিকে রাজধানী ঢাকার এস্টোরিয়ন থেকে উদ্ধারও করা হয় চোরাই পণ্য। পুলিশ মামলা দুটির অভিযোগপত্রও ২০১৫ সালে আদালতে জমা করে। অভিযোগপত্রে দুটি ধারা উল্লেখ করা হয়। যার একটি ৪১৩, অন্যটি ৪১১। একটির জিআর মামলা নম্বর ১৫০/১৫। এটি চট্টগ্রাম চিফ মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন। অপরটি জিআর মামলা নম্বর ১৪৫/১৫। সেটির বিচার চলছে চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট পঞ্চম আদালতে।

এ বিষয়ে সিনিয়র আইনজীবী জিয়া আহসান হাবীব আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, ৪১১ ও ৪১৩ দুটো ধারাই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এরমধ্যে ৪১১ ধারা হলো চোরাই পণ্য জেনেও হেফাজতে রাখা। আর ৪১৩ ধারামতে অভ্যাসগতভাবে চোরাই মালামাল বেচাকেনার জন্য হেফাজতে রাখা।

আদালত সূত্রে জানা জানা যায়, মামলা দুটি করে ইপিজেডের দুটি কারখানার কর্তৃপক্ষ। এরমধ্যে একটি মামলার বাদি কর্ণফুলী স্পোর্টস ওয়ার ইন্ড্রাস্টিজ লিমিটেডের এডমিন ম্যানেজার তৌহিদুল ইসলাম। অপর মামলারি বাদি তিতাস স্পোর্টস ওয়ার ইন্ড্রাস্টিজ লিমিটেডের এডমিন ম্যানেজার মনির হোসেন মজুমদার।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, এটা তো ভয়ঙ্কর ব্যাপার। যাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার কথা সেই পুলিশই চুক্তি করেছে এক আসামির সঙ্গে! যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুটি মামলা রয়েছে। চোরাই বাণিজ্যের আসামিকে এভাবে সিএমপি নিজস্ব সম্পত্তিতে ব্যবসার সুযোগ দেওয়াটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

তিনি বলেন, একজন আসামির সঙ্গে চুক্তি করে পুলিশ খুবই খারাপ নজির স্থাপন করেছে। একজন ব্যক্তি সম্পর্কে খোঁজ না নিয়েই ‍পুলিশ চুক্তি করবে— এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আর এমন হলে এটি তো পুলিশের চরম গাফিলতি। তবে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন— সত্যিকার অর্থে না জেনে এই চুক্তি হয়েছে, নাকি কোনো যোগসাজশে এই অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে। পুলিশের ভাবমূর্তি রক্ষায় অবশ্যই বিষয়টি সিএমপি কর্তৃপক্ষের খতিয়ে দেখা উচিত।

আরও পড়ুন: এক পারভীনের—শত রূপ, আটকে গেলেন পুলিশের জালে

এদিকে এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় সিএমপি উপকমিশনার (সদর) আমির জাফরের সঙ্গে। বিষয়টি শুনেই তিনি হতবাক হয়ে পড়েন। তিনি আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। এটি যাচাই-বাছাই করা হবে। এরপর কারো সংশ্লিষ্টতা পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অপরদিকে অভিযুক্ত হুমায়ুন কবিরকে মুঠোফোনে মামলার বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি প্রতিবেদককে ‍উল্টো প্রশ্ন করেন, আমার মামলার বিষয়ে আপনার জেনে কী লাভ?

এরপর তিনি হুমকির সুরে বলেন, অপেক্ষা করেন। আমি সিএমপি কমিশনারকে এখনিই জানাচ্ছি। ওনি আপনাকে ফোন করবে।

এই বলে ফোনের সংযোগ কেটে দেন হুমায়ুন কবির। এর কিছুক্ষণ পরই ফোন আসে প্রতিবেদকের মুঠোফোনে। ফোন করেন সিএমপির গোয়েন্দা পুলিশের বড় এক কর্মকর্তা। শুরুতেই তিনি জানতে চান হুমায়ুন কবিরকে ফোন করার বিষয়ে। এরপর তিনি প্রতিবেদনটি প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, হুমায়ুন কবির এখন ঢাকায়। তিনি আমার আত্মীয়ের মতোই। ঢাকা থেকে এলে তিনি আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।

আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!