চট্টগ্রামে মুরগির বাজারও সিন্ডিকেটের কবলে, বাজারে নেই মনিটরিং, বিপাকে রেস্টুরেন্ট শিল্প

কিছুই জানে না জেলা প্রশাসন

চট্টগ্রামে দফায় দফায় দাম বাড়িয়ে মুরগির বাজার অস্থিতিশীল করে তুলেছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। গত কয়েকদিনে দেশের বাজারে জ্বালানি তেলসহ মুরগির খাবার কিংবা অন্যান্য উপাদানের দাম না বাড়লেও মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা কেজিপ্রতি ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়িয়েছে প্রায় ৫০ টাকা! এছাড়া দেশি ও সোনালি মুরগির দামও বাড়িয়েছে প্রায় ২০ থেকে ৩৫ শতাংশ। এভাবে দাম বাড়িয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।

এদিকে মুরগির বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করলেও সেদিকে নজর নেই চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর। নগরের বাজারগুলোতে অনেকদিন ধরে নেই কোনো অভিযান। রমজান মাস, বিয়েসহ বিভিন্ন আয়োজনে মুরগির ব্যাপক চাহিদাকে পুঁজি করে ব্যবসায়ীদের এমন লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিপাকে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীরা। অথচ এসবের কিছুই জানে না চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।

নগরের বিভিন্ন খুচরা বাজারে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে কেজি ২০০ থেকে ২১০ টাকা। যা গত ৭-৮ দিন আগেও ছিল কেজি ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা। সোনালি মুরগি বিক্রি হচ্ছে কেজি ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা, যা কয়েকদিন আগেও বিক্রি হয়েছিল ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা। এছাড়া দেশি মুরগি বিক্রি হচ্ছে আকারভেদে কেজি ৪৯০ থেকে ৫২০ টাকা।

নগরের রিয়াজউদ্দিন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মুরগির বিভিন্ন আড়তে পাইকারি মূল্যে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৯০ থেকে ১৯২ টাকা কেজি দরে। সোনালি মুরগি বিক্রি ২৮০ থেকে ২৯০ টাকা এবং দেশি মুরগির কেজি ৪৬০ থেকে ৪৭০ টাকা। মূলত নগরের ভোক্তা পর্যায়ে মুরগির ব্যাপক দাম বৃদ্ধির জন্য পাইকারি বাজারের আড়তদারদের দায়ী করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।

ভোক্তা পর্যায়ে মুরগি বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ‘আলামিন পোল্ট্রি অ্যান্ড সেলস সেন্টার’র স্বত্বাধিকারী মো. মহিউদ্দিন সওদাগর আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, শীতের শুরু থেকে মুরগির দাম কম ছিল। কিন্তু শীত কমে যাওয়ার পর থেকে হঠাৎ মুরগির দাম বেড়ে গেছে। আমরা আড়ত থেকে পাইকারি মূল্যে মুরগি কিনে খুচরা মূল্যে কাস্টমারদের কাছে বিক্রি করি। আজ আড়ত থেকে আমরা ব্রয়লার মুরগি কিনেছি কেজি ১৯০ টাকা দরে। কাস্টমারদের কাছে খুচরা মূল্যে কেজি ২০০ টাকা করে বিক্রি করছি। ব্যবসা যেহেতু করছি, কেজিতে ৫/১০ টাকা তো লাভ করতেই হবে। দাম বৃদ্ধিতে খুচরা ব্যবসায়ীদের কোনো হাত নেই, এর জন্য খামারি আর আড়তদাররা দায়ী।

এদিকে মুরগির হঠাৎ দাম বৃদ্ধি নিয়ে কয়েকজন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা হয় আলোকিত চট্টগ্রামের। তারা জানান, মুরগির বাচ্চা ও খাবারের দাম বৃদ্ধি হওয়ায় বাজারে মুরগির এত দাম। আবার কেউ কেউ বলেছেন, মুরগির ভ্যাক্সিনেশনসহ রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয়ও বেড়েছে, তাই মুরগির দামও বেড়েছে।

পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, গত এক সপ্তাহের মধ্যে মুরগি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে বাড়েনি মুরগির বাচ্চার দাম। সর্বশেষ মুরগির বাচ্চার দাম বেড়েছিল প্রায় ২০-২২ দিন আগে। সেই সময় ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার দাম বৃদ্ধির সঙ্গে বাজারদর সমন্বয় করে প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি ১২০ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হয়েছিল ১৩৫ টাকা। এছাড়া গত এক সপ্তাহের মধ্যে মুরগির খাবারের দামও অপরিবর্তিত রয়েছে। মুরগির খাবারের সর্বশেষ দাম বেড়েছিল গত বছরের নভেম্বরে। একইভাবে গত ৮-১০ দিনের মধ্যে খামারে মুরগির ভ্যাক্সিনেশনসহ রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়েরও কোনো পরিবর্তন হয়নি। অথচ বাজারে বিভিন্ন জাতের মুরগির দাম হুট করে প্রায় ২০ থেকে ৪৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগরের বৃহৎ মুরগির পাইকারি বাজার রিয়াজউদ্দিন বাজারের আড়তদাররা বিভিন্ন খামার থেকে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি দরে মুরগি কিনে। একটি মাঝারি আকারের আড়ত খামার থেকে প্রতি চালানে ২-৩ হাজার পিস মুরগি কিনে। ওজনে হিসাব করলে তা দাঁড়ায় প্রায় ৫ হাজার কেজি। এই হিসাবে আড়তদাররা খামার থেকে প্রতি ৫ হাজার কেজি মুরগি ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকায় কিনে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছে ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। এভাবে এসব আড়তদারর্ প্রতি চালানে লাভ করছে প্রায় ২ লাখ টাকা!

মুরগির ‘মনগড়া’ দাম বাড়িয়ে গত ১০-১২ দিনে প্রতিটি আড়তদার প্রতিষ্ঠান প্রায় ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এছাড়া আগামী রমজানের আগে নগরজুড়ে বেড়েছে বিয়েসহ অন্যান্য আয়োজন। এসব আয়োজনে রয়েছে ব্রয়লার মুরগির ব্যাপক চাহিদা। আবার বর্তমানে আবহাওয়ার উষ্ণতাও বেড়েছে। গরমে মুরগি মরে যাওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। তাই আড়তদার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এসব প্রেক্ষাপটকে পুঁজি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতে ইচ্ছেমতো বাড়িয়েছে মুরগির দাম।

এদিকে মুরগির এমন দাম বৃদ্ধিতে বেকায়দায় পড়েছে নগরের রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীরা। রেস্টুরেন্টগুলোতে শর্মা, গ্রিল, চপ, বার্গার, পিৎজাসহ নানা খাবারে মুরগি ব্যবহার করা হয়। মুরগির দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন এসব আইটেমের সঙ্গে দামের সামঞ্জস্য নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছে রেস্টুরেন্টগুলো।

যোগাযোগ করা হলে তাসফিয়া গার্ডেন রেস্টুরেন্টের মালিক নাজিম উদ্দীন চৌধুরী এ্যানেল বলেন, মুরগির এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রেস্টুরেন্ট শিল্পের জন্য বড় ক্ষতিকর। শুধু তাই নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যে অধিকাংশই এই ফার্মের মুরগির ওপর নির্ভরশীল। আমি মনে করি, মুরগির এই অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির পেছনে কোনো সিন্ডিকেট কাজ করছে। এই শোষণের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলার সহকারী পরিচালক নাসরিন আক্তারের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মো. ফখরুজ্জামান আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, মুরগির বাজারদরের বিষয়টি আসলে আমাদের জানা ছিল না। এ ধরনের কোনো তথ্যও জানা ছিল না। আপনি যেহেতু বলেছেন, আমরা বিষয়টি দেখবো। চিনির বিষয়টি আমাদের নলেজে আসার পর আমরা অভিযান চালিয়েছিলাম। এরপর চিনির দাম কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। এখন মুরগির বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নেব।

এসআই/আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!