চট্টগ্রামে পথে পথে পণ্য নিয়ে কষ্ট-ক্লান্তির দিন কাটাচ্ছে ওরা

মো. গিয়াস উদ্দিন, পেশায় একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। সারাদিন নগরের বিভিন্ন জায়গায় ফুটপাতে বসে লেবু বিক্রি করেন। ছেলে-মেয়ে-স্ত্রীসহ চারজনের সংসার তাঁর। সারাদিনের বেচা-বিক্রির টাকা দিয়েই চলে তার সংসার। এতদিন ভালোভাবেই চলছিল, তবে ইদানিং রাজ্যের সমস্ত হতাশা যেন ভর করেছে তাঁর মনে।

একদিকে পারিবারিক চাপ, অন্যদিকে কমে গেছে বিক্রি। নিজের কোনো সঞ্চয়ও নেই। এরমধ্যে দুর্ভিক্ষের আতঙ্ক যেন দিন দিন গ্রাস করছে তাঁকে। তাই পণ্য বিক্রি করতে বসেই হতাশা আর মানসিক বিষণ্নতায় ব্যবসাস্থলেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছেন তা নিজেই জানেন না ৭২ বছর বয়সী গিয়াস উদ্দিন।

গিয়াস উদ্দিনের বাড়ি ঢাকার সোনারগাঁওয়ের ফুলবাড়িয়া এলাকায়। তবে জীবিকার তাগিদে এসেছেন চট্টগ্রাম। লেবুর আড়ৎ থেকে পাইকারি দরে লেবু কিনে সারাদিন নগরের বিভিন্ন জায়গায় ফুটপাতে বসে বিক্রি করেন। আগে দিনে ২-৩ হাজার টাকার লেবু বেচে ৭শ-৮শ টাকা লাভ হতো। তা দিয়ে ভালোভাবেই চলতো সংসার। তাই এতদিন বাসা ভাড়া নিয়ে পরিবারসহ চট্টগ্রামে বসবাস করে আসছিলেন।

তবে এখন জীবনের সমীকরণটাই বদলে গেছে। বেচা এত বেশি কমে গেছে, এখন আর পরিবার নিয়ে শহরে বসবাস করা গিয়াস উদ্দিনের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তাই এরমধ্যে পরিবারের সদস্যদের পাঠিয়ে দিয়েছেন গ্রামের বাড়ি। ৭২ বছর বয়সে সংসারের ঘানি টানতে একাই থেকে গেলেন শহরে।

নগরের চেরাগী পাহাড় মোড়ে ফুটপাতে বসে যখন কথাগুলো বলছিলেন, পানিতে তখন তাঁর চোখ টলমল করছিল। আলোকিত চট্টগ্রামকে তিনি বলেন, রিয়াজউদ্দিন বাজারের আড়ৎ থেকে গত তিনদিন আগে ৩০০ পিস লেবু কিনে এনেছিলাম ৩০০ টাকা দিয়ে। এখনও অর্ধেক রয়ে গেছে। এর মধ্যে দিনে ২০ টাকা করে তিনদিনে পুলিশকে দিতে হয়েছে ৬০ টাকা। আগে দিনে ২ থেকে ৩ হাজার টাকার লেবু বিক্রি হতো। তখন ভালোই লাভ হতো। ইদানিং বেচা-বিক্রি খুবই কমে গেছে।’

তিনি বলেন, এখন দিনে যা বিক্রি হয়, তা দিয়েতো নিজে চলতে হিমশিম খাচ্ছি, বাড়িতে পরিবারের কাছে টাকা পাঠাবো কেমনে? আবার বাড়িতে টাকা না পাঠালে বউ-পোলা না খেয়ে থাকবে। এটাওতো মানতে কষ্ট হচ্ছে। অন্যান্য খরচসহ লেবুর ডজন ১৫ টাকা করে পাইকারি কিনে ডজন ২০ টাকা করে বিক্রি করছি। এখানে নিজের বাসা ভাড়া, খাওয়া-দাওয়ার খরচ করব, নাকি বাড়িতে পরিবারের কাছে টাকা পাঠাবো? রাজ্যের দুশ্চিন্তায় শরীর ক্লান্ত হয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি!

তিনি বলেন, এর মধ্যে শুনছি সামনে নাকি দেশে দুর্ভিক্ষ হবে। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ দেখেছি, তখন ২৪ বছরের যুবক ছিলাম। এখন ৭২ বছর বয়সে পরিবার-পরিজন নিয়ে দুর্ভিক্ষ কীভাবে সামলাবো বুঝতে পারছি না। ব্যবসা যাচ্ছে খারাপ, তার ওপর নেই কোনো সঞ্চয়। দুর্ভিক্ষ হলেতো পরিবার নিয়ে না খেয়েই মরতে হবে।

গিয়াস উদ্দিনের পাশে বসে কলা বিক্রি করছিলেন আব্দুল মোতালেব (৪৩)। তাঁর চোখে-মুখেও ভর করেছে হতাশা।

আব্দুল মোতালেবের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। পরিবার নিয়ে বসবাস করেন চট্টগ্রামে। এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে তাঁর চার সদস্যের পরিবার। নগরের চেরাগী পাহাড় এলাকায় ফুটপাতে বসে সারাদিন কলা বেচে করে যা রোজগার হয়, তা দিয়ে চলে সংসার। আগে তাঁর দৈনিক বিক্রি ছিল ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। এখন তা এসে ঠেকেছে দেড় থেকে দুহাজারে। বাসা ভাড়া, পরিবারের দৈনন্দিন বাজার খরচ, ছেলেমেয়ের পড়ালেখার খরচ নিয়ে বর্তমানে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছেন তিনি।

আব্দুল মোতালেব বলেন, একদিকে শীতকালের শুরুতে পাইকারি বাজারে কলার দাম বাড়তি, অন্যদিকে কলার বিক্রি কমেছে। আগে দিনে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা বিক্রি করলে হাজারখানেক টাকা লাভ থাকত। এখনতো দিনে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা বিক্রি করতেই হিমশিম খেতে হয়। দিনে লাভ হয় ৪শরথেকে ৫শ টাকা। তা দিয়ে সংসার চালানো খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, ভোর সাড়ে ৫টার মধ্যে নাস্তা করে আড়তে গিয়ে কলা কিনে সারাদিন বিক্রি করি। এর মধ্যে দুপুরে আরেকজনের সঙ্গে ভাগাভাগি করে একটা তরকারি নিয়ে কোনোরকমে হোটেলে খাবার খেতে হয়। নিজে কম খেয়ে হলেও তো পরিবারের জন্য টাকা পাঠাতে হবে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচতো আছেই। তারওপর অসুখবিসুখে টাকা লাগে।

তিনি আরও বলেন, এমনিতে বেচা নেই, ফুটপাতে বসলেই পুলিশকে দিতে হয় ২০ টাকা। এরমধ্যে কিছুদিন আগে স্থানীয় কাউন্সিলর এসে ফুটপাতে বসার দায়ে আমার প্রায় ৬ হাজার টাকার মালামাল ময়লার ভাগাড়ে ফেলে দিয়েছিল।

চাঁদপুরের রামপুর ইউনিয়নের কামরাঙ্গা গ্রাম থেকে এসে চট্টগ্রামে সপরিবারে বসবাস করেন মো. আজাদ (৫৫)। শিক্ষামন্ত্রী দিপু মনির বাড়ির পাশেই তাঁর বাড়ি। তবে মুদ্রার উল্টো পিঠেই যেন বয়ে চলছে তাঁর জীবন।

পেশায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আজাদ বছরের বিভিন্ন সময় নানা পণ্যের ব্যবসা করেন। শহরের ফুটপাতে কখনও পেঁপে-আনারস, কখনও কলা, আবার কখনও নানা রকমের সবজি বেচেন তিনি।

গিয়াস উদ্দিন ও আব্দুল মোতালেবদের মতো তাঁর কণ্ঠেও করুণ সুর। চেহারায় ভর করেছে অনিশ্চিয়তার ছাপ। তিনি আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, সারাদিনে দেড়-দুহাজার টাকা বিক্রি করলে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা লাভ হয়। এক পন (৮০ পিস) কলা কেনা পড়ে ৬০০ টাকা। ডজন ১০০-১২০ টাকা বিক্রি করতে হয়। কিন্তু অনেক সময় ডজন ৯০ টাকা কিনে ৭০ টাকায়ও বিক্রি করতে হয়।

তিনি বলেন, ইদানিং ব্যবসা খুবই খারাপ যাচ্ছে। মাসের ১০ তারিখের মধ্যে ৯ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিতে হয়। সংসারে প্রতিদিনের খরচের পাশাপাশি আছে ছেলেমেয়ের পড়ালেখার খরচও। আমার ছেলে সাব্বির এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। দেশে দুর্ভিক্ষের কথা হচ্ছে, বাজারে সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। খরচ যে পরিমাণে বেড়েছে, সে পরিমাণে আয় বাড়ল না। তাই এখন সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!