সিনেমার আন্ডারওয়ার্ল্ড ‘বাস্তব’ বগারবিলে, গলির রাজা ‘বড় ভাই’

অপরাধপ্রবণ এলাকার ‘ঐতিহ্য’ অনেকদিনের। অপরাধীদের ‘নিরাপদ’ ডেরা হিসেবেও আছে পরিচিতি। চট্টগ্রামের চিহ্নিত সেই ক্রাইমজোন বগারবিল এখন সিনেমার আন্ডারওয়ার্ল্ডের বাস্তব সংস্করণ। অপরাধের মূল নির্দেশদাতা যেখানে গলির রাজা ‘বড় ভাই’, অপরাধীরা দাপট দেখান যার প্রশ্রয়ে।

নগরের পশ্চিম বাকলিয়ার বগারবিল এলাকা একসময় গলাকাটা কিংবা পুতে ফেলা লাশের সন্ধানের কারণে নিয়মিত খবরের শিরোনাম হতো। সেসময় বগারবিলের বড় একটা অংশে ছিল না জনবসতি। অপরাধীরা তাই রাতের আঁধারে অনেকটা নীরবে-নিভৃতেই নিজেদের ‘কাজ’ সেরে পালিয়ে যেতেন।

দিন পাল্টেছে। এখন চট্টগ্রামের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা বগারবিল। এলাকার নামেও এসেছে পরিবর্তন। মানুষ এই এলাকাকে এখন চেনে ‘শান্তিনগর’ হিসেবে।

তবে এলাকার নাম পাল্টালেও অপরাধপ্রবণতা কমেনি। বরং সময়ের সঙ্গে পাল্টেছে অপরাধের ধরন। হাতবদল হয়েছে নেতৃত্বের। আগে যেখানে রাতের আঁধারে নীরবে-নিভৃতে অপরাধ চলত, এখন সেখানে প্রকাশ্যেই সংঘটিত হয় সন্ত্রাস-মাদকবাণিজ্য, দেশীয় অস্ত্রের মহড়া।

স্থানীয়দের অভিযোগ, চকবাজার থানা পুলিশের ‘নির্বিকার’ ভূমিকা অপরাধীদের প্রশ্রয় যোগাচ্ছে। আগে নিয়মিত টহল পুলিশের দেখা মিললেও, অপরাধের মাত্রা বাড়ার সঙ্গে কমেছে তাও। থানায় অনেক অভিযোগ জমা পড়লেও সাম্প্রতিক অতীতে মাদক-সন্ত্রাসবিরোধী বড় কোনো অভিযান চালাতে দেখা যায়নি পুলিশকে। যে কারণে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছেন স্থানীয় অপরাধীরা।

কিশোর গ্যাংয়ের দাপট, নেতৃত্বে ‘বড় ভাই’

বগারবিল এলাকায় এখন দিনে-রাতে দেখা মেলে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের। কখনও এলাকার প্রভাবশালী ‘বড় ভাই’, কখনও সরকারি দলের নেতার নাম ভাঙিয়ে এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা এলাকায় দাপট দেখিয়ে বেড়ায়।

বগারবিল এলাকায় মূলত দুটি এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। একটি অংশ শান্তিনগর বাজারকেন্দ্রিক, অন্যটি কালাম কলোনি এলাকার। এই দুই গ্যাংয়ের মধ্যে আবার গলিকেন্দ্রিক অনেকগুলো উপ-গ্যাং রয়েছে। যে যার গণ্ডিতে মাদকসেবন ও বিক্রি, চুরি, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ করে চলে।

স্থানীয় বড় ভাইয়ের ছায়ায় তারা এ অপকর্ম করে। কখনও সেই বড় ভাইয়ের নির্দেশে, কখনও তার অজান্তেই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধে অংশ নেয়। সেই বড় ভাইরা আবার ক্ষমতাসীন দলের নগর নেতাদের ‘বিশ্বস্ত কর্মী’ পরিচয়ে নিজ নিজ ‘সীমানা’ দখলে রাখেন। বড় কোনো ঘটনা হলে সাধারণ কর্মীরাই ফেঁসে যান, বড় ভাইরা থেকে যান আড়ালে।

চুরি থেকে অপহরণ, চলে অস্ত্রের মহড়া

ছোটখাটো চুরি থেকে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ— বগারবিলের নিয়মিত ঘটনা। কিছু আইনের আওতায় আসে, কিছু স্থানীয়ভাবেই মীমাংসা করা হয়। আবার অনেক ভুক্তভোগী আইনগত ঝামেলা এড়াতে কিছু ঘটনা চেপে যান।

চুরি বগারবিলের প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা। ছোট শিশু থেকে কিশোর, এমনকি মধ্যবয়স্ক নারী-পুরুষও চুরির দায়ে ধরা পড়েছেন একাধিকবার। সাধারণ গৃহস্থালী সামগ্রী, বাড়ির ফল থেকে নগদ টাকা, মোবাইল, স্বর্ণালংকার— কোনোকিছুই এখানকার চোরদের ‘টার্গেট’ থেকে বাদ যায় না।

বগারবিলে একাধিক অপহরণের ঘটনাও ঘটেছে। ২০১৫ সালে ভুট্টো বড়ুয়া নামে এক মাছ ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে বগারবিল এলাকার একটি বাসায় রেখে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। খবর পেয়ে পুলিশ ওই বাসা থেকে অপহৃতকে উদ্ধার ও দুইজনকে আটক করে। এছাড়া গতবছর কৃষ্ণ সরকার নামে এক গার্মেন্টস কর্মীকে জিম্মি করে মুক্তিপণ দাবির অভিযোগে মো. লিটন নামে বগারবিলের এক যুবককে গ্রেফতার এবং অপহৃতকে উদ্ধার করে পুলিশ।

বাড়ি নির্মাণ বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে চাঁদাবাজির শিকার হয়েছেন বগারবিলের অনেক বাসিন্দা। বড় অঙ্কের চাঁদা দিয়ে অনেকে ঝামেলা বিদায় করেছেন, আবার চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে সমস্যায় পড়েছেন অনেকে।

দিন কিংবা রাত, বগারবিলে ছোটখাটো ঘটনাতেও দেশি অস্ত্রের মহড়া নতুন কিছু নয়। অনেকসময় তুচ্ছ ঘটনাতেও বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ ঘরে থাকা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ‘জবাব’ দিতে বেরিয়ে পড়েন। কখনও কখনও তা রূপ নেয় বড় ধরনের সংঘর্ষে।

প্রকাশ্যে মাদকসেবন ও বিক্রি, মোড়ে মোড়ে জুয়ার আসর

বগারবিল এলাকার অন্যতম সমস্যা মাদক বিক্রি ও সেবন এবং জুয়ার আসর। এলাকায় রাতেতো বটেই, অনেকসময় দিনদুপুরে প্রকাশ্যেই বসে মাদক-জুয়ার আসর।

নিম্নবিত্ত শ্রেণির শ্রমজীবীদের অনেকেই সারাদিনের কষ্টার্জিত টাকা নিয়ে বসে যান জুয়ার আড্ডায়। স্থানীয় কিছু যুবকের সুচতুর প্রতারণায় অনেকক্ষেত্রেই তাদের শূন্য হাতে ফিরতে হয় ঘরে।

আবার কিশোর-যুবক থেকে শুরু করে এলাকার বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ গাঁজা-ইয়াবাসহ নানা মাদকে আসক্ত। এলাকায় তাই মাদক বিক্রিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বড় সিন্ডিকেট। মাদকের টাকা যোগাড় করতে অনেকে চুরি-ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েন।

অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী পরিচয় দেওয়া স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এলাকায় নানা অপরাধের সঙ্গে সঙ্গে মাদক-জুয়ার আড্ডাও পরিচালিত হয়ে আসছে।

ভারতের জনপ্রিয় ক্রিকেট প্রতিযোগিতা আইপিএল শুরু হলেই বগারবিল এলাকার চায়ের দোকানগুলোতে বসে জুয়ার আসর। প্রতিযোগিতার দলগুলোর জয়-পরাজয় নিয়ে বাজি ধরেন মৌসুমি জুয়াড়িরা। তবে শুধু জয়-পরাজয় নয়, ওভারে রান, চার-ছয়, উইকেট নিয়ে পর্যন্ত বাজি ধরা হয়।

এর বাইরে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ক্যারাম, লুডু খেলা নিয়েও বাজি ধরা হয়। তাসের জুয়াও চলে ছোট-বড় পরিসরে। জুয়ায় জড়িয়ে অনেকে নিজের ব্যবসার পুঁজি পর্যন্ত খুঁইয়েছেন। অনেকে ঋণে হয়েছেন জর্জরিত। জুয়ার টাকা আদায় বা জুয়ার অঙ্ক নিয়ে মতবিরোধে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ অনেক

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আবদুল লতিফ বাই লেইনের এক বাসিন্দা জানালেন অনেক অভিযোগ। প্রাক্তন এই সরকারি কর্মকর্তা আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, এই এলাকায় রয়েছি দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে। সম্প্রতি এখানে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত বেড়ে গেছে। এরা প্রকাশ্যেই মাদকসেবন করে, জিনিসপত্র চুরি করে, বাধা দিলে হুমকি দেয়।

তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আমরা পুলিশকে জানিয়েছি। কিন্তু লাভ হয়নি।

পোড়া কলোনি গলির বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী মু. জুনাইদ বলেন, বগারবিল এলাকা এখন মাদকের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। বাড়ির আঙিনা, নির্মাণাধীন ভবন এমনকি রাস্তায়ও প্রকাশ্যে চলে মাদকসেবন। এছাড়া চুরি-ছিনতাই লেগেই আছে। দিনদুপুরে রাস্তায় বসে জুয়া খেলাও এখানকার প্রতিদিনের চিত্র।

পুলিশ কী বলছে?

দীর্ঘদিন ধরে বগারবিল এলাকায় একরকম প্রকাশ্যেই অপরাধ চললেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো অভিযান চালানো হয়নি। বরং অভিযোগ রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ‘ম্যানেজ’ করে দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় প্রকাশ্যে অপরাধ করে চলেছেন স্থানীয় অপরাধীরা।

এ ব্যাপারে জানতে চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর মাহমুদকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তবে কিছুদিন আগে তাকে এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি ‘ব্যবস্থা নেওয়া হবে’ বলে জানিয়েছিলেন।

যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) বিজয় বসাক আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, বিষয়টা শুনলাম। দেখছি। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!