চট্টগ্রামে নগদ টাকায় ‘চটজলদি’ করোনার টিকা, মধ্যস্থতায় ‘কাছের বন্ধু’

সরকারিভাবে বিনামূল্যে প্রদানের জন্য নির্ধারিত করোনার টিকা এখন নগদ টাকায় বিক্রি চলছে চট্টগ্রামে। নগরজুড়ে তুমুল সমালোচনার পর প্রশাসনের কর্তারা ‘নড়েচড়ে’ বসলেও টিকা বিক্রি চক্রের মূল হোতারা এখনও রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, বিনামূল্যের টিকা বিক্রির খবর মূলত ছড়ায় বন্ধু থেকে বন্ধু কিংবা পরিচিতজনের মাধ্যমে। টিকা দেওয়াও হয় গোপনে। সম্প্রতি মো. হাসান নামে এক টিকাগ্রহীতার ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে একটি ঘটনা জনসম্মুখে এলেও, অভিযোগ রয়েছে চট্টগ্রামে নগদ টাকার বিনিময়ে এভাবে টিকা দেওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। চট্টগ্রামে শুধু টিকা বিক্রিকে ঘিরেই বড় অংকের অর্থ লুটে নিচ্ছে একশ্রেণির অসাধু ব্যক্তি।

জানা যায়, দেশজুড়ে শুরু হয়েছে করোনার গণটিকাদান কর্মসূচি। সরকারিভাবে বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে টিকা। শনাক্তের সংখ্যা বৃদ্ধি ও ইতিবাচক প্রচারণার কারণে টিকার প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহও এখন তুঙ্গে। কোথাও ভোর থেকে, কোথাও আগের রাতেই টিকার জন্য লাইনে দাঁড়াচ্ছেন মানুষ।

অভিযোগ রয়েছে, টিকার প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহকে পুঁজি করে রীতিমতো ব্যবসা শুরু করে দিয়েছেন কিছু ব্যক্তি। নির্ধারিত স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে গোপনে টিকা সরিয়ে নিয়ে তারা নগদ টাকার বিনিময়ে তা দিচ্ছেন আগ্রহী টিকাগ্রহীতাদের।

তবে সম্পূর্ণ বেআইনী এ টিকাদানের পুরো প্রক্রিয়াটিই চলছে বেশ গোপনে। এক বন্ধু থেকে আরেক বন্ধু কিংবা পরিচিতজনদের মাধ্যমেই চলে টিকার প্রচারণা।

‘পার্টি’ টাকা নিয়ে তৈরি থাকলে নির্ধারিত স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে দেওয়া হয় করোনার টিকা। এজন্য ডোজ প্রতি নগদ এক হাজার টাকা কিংবা কিছুক্ষেত্রে তারচেয়েও বেশি টাকা নেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

গত কিছুদিনে এমন দুটি অভিযোগকে ঘিরে তোলপাড় সৃষ্টি হয় চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগে। দুটি ঘটনাতেই জড়িয়ে গেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) একাধিক কর্মীর নাম। এরমধ্যে হাজারী গলিতে টাকার বিনিময়ে টিকা দেওয়ার অভিযোগের বিষয়টি এখনও তদন্তাধীন রয়েছে। সর্বশেষ নগরের খুলশীতে ‘ঘরে বসেই টিকা’ দেওয়ার অভিযোগের শক্ত প্রমাণ এরমধ্যেই পেয়ে গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। চারজনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে দুজনকে। তদন্ত কমিটি গঠনের পাশাপাশি অভিযুক্ত স্বাস্থ্যকর্মীকে করা হয়েছে চাকরিচ্যুত।

যেভাবে প্রকাশ্যে ‘ঘরে বসে টিকাকাণ্ড’

শুরুটা মোবারক আলীর মাধ্যমে। বন্ধু হাসানকে শিখিয়ে দেন করোনার টিকা নেওয়ার ‘শর্টকাট’। টিকাদান কেন্দ্রে লাইনে দাঁড়িয়ে কষ্ট করার বদলে মাত্র এক হাজার টাকায় ঘরে বসেই মিলবে টিকা!

খবর পৌঁছে যায় আরেক বন্ধু সাজ্জাদের কাছেও। ‘সুযোগটা’ লুফে নেন দুই বন্ধুই। মোবারক আলীর মধ্যস্থতায় টিকাদানকারীর সঙ্গে দুজনের পাকা কথাও হয়ে যায়।

শনিবার (৭ আগস্ট) প্রতি ডোজ নগদ এক হাজার টাকার বিনিময়ে চসিকের অস্থায়ী টিকাদানকেন্দ্রের কর্মী বিষু দে খুলশীর বাসায় এসেই দুজনকে দিয়ে যান টিকা!

চট্টগ্রামে আলোড়ন তোলা এই টিকাকাণ্ডের পেছনের গল্পটা এভাবেই উঠে এসেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা তপন কুমার চক্রবর্তীর দায়ের করা মামলার এজাহারে।

চসিকের কাপাসগোলা ইপিআই জোনের জোনাল মেডিকেল অফিসার তপন কুমার চক্রবর্তী এ ঘটনায় বাদী হয়ে দণ্ডবিধির ৩৮০, ৪০৬ ও ৪২০ ধারায় চার জনকে আসামি করে মামলাটি করেছেন নগরের খুলশী থানায়। মামলার চার আসামি হলেন- মো. হাসান, মোবারক আলী, মো. সাজ্জাদ ও বিষু দে।

বিষু দে চসিকের অস্থায়ী টিকাদানকেন্দ্র উত্তর কাট্টলী মোস্তফা হাকিম ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রের করোনার টিকা প্রদান কার্যক্রমে দায়িত্বরত ছিলেন।

এরআগে চাঞ্চল্যকর এই টিকাকাণ্ড প্রচারের আলোয় আসে মূলত টিকা নেওয়া মো. হাসানের একটি ‘ভুলে’র কারণে। রোববার (৮ আগস্ট) হাসান ‘বাসায় বসে ভ্যাকসিন নেওয়া’র একটি ছবি ফেসবুকে আপলোড করেন।

সেই পোস্টে তিনি উল্লেখ করেন, ‘ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। অশেষ ধন্যবাদ বন্ধু মো. মোবারক আলীকে কোভিড ভ্যাকসিন প্রদানে সহায়তা করার জন্য। আলহামদুলিল্লাহ, মর্ডানার ১ম ডোজ সম্পন্ন।’

সেই ফেসবুক স্ট্যাটাসটি ছড়িয়ে পড়ার পর নগরে শুরু হয় সমালোচনা। পরে ফেসবুক থেকে স্ট্যাটাসটি মুছে ফেলা হলেও সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে রোববার রাতেই হাসানকে গ্রেপ্তার করা হয়। সোমবার সকালে গ্রেপ্তার করা হয় মোবারক আলীকেও।

কে এই বিষু?

চসিক সূত্রে জানা যায়, অভিযুক্ত স্বাস্থ্যকর্মী বিষু দে চসিকের আলহাজ্ব মোস্তফা হাকিম মাতৃসদন হাসপাতালে টেকনিশিয়ান পদে চুক্তিভিত্তিক দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।

মূলত মোবারক আলীর মাধ্যমেই হাসান ও সাজ্জাদের সঙ্গে পরিচয় তাঁর। ডোজ প্রতি নগদ এক হাজার টাকায় ঘরে গিয়েই টিকা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।

চসিক কর্মকর্তার দায়ের করা মামলায় দাবি করা হয়, বিষু দে নির্দিষ্ট টিকাদানকেন্দ্রের জন্য নির্ধারিত টিকা চুরি করে বাসায় গিয়ে দিচ্ছিলেন। এজন্য ডোজ প্রতি নিচ্ছিলেন নগদ এক হাজার টাকা করে।

পরে নগরজুড়ে সমালোচনার পর চসিকের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলেও বুধবার (১১ আগস্ট) সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা যায়নি তাঁকে।

ফোন ধরেননি সিভিল সার্জন ও স্বাস্থ্য পরিচালক

এ ব্যাপারে জানতে ফোন করা হলেও রিসিভ করেননি চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির। অন্যদিকে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি কল কেটে দেন।

‘খতিয়ে দেখছে চসিক’

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সচিব খালেদ মাহমুদ আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখছে চসিক। পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

টিকাকাণ্ডে বার বার চসিকের নাম কেন আসছে- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আগের ঘটনাটি (হাজারী গলি) এখনও প্রমাণ হয়নি। তবে খুলশীর ঘটনাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। ইতোমধ্যে অভিযুক্ত অস্থায়ী স্বাস্থ্যকর্মী বিষু দে-কে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে আরও জানতে তিনি চসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিম আকতার চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।

ডা. সেলিম আকতার চৌধুরীকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। তার মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি।

সেই স্বাস্থ্যকর্মী বরখাস্ত, তদন্ত কমিটি গঠন

চট্টগ্রামজুড়ে সমালোচনার পর টিকাকাণ্ডে অভিযুক্ত স্বাস্থ্যকর্মী বিষু দে-কে বরখাস্ত করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। এদিকে এ ঘটনা তদন্তে চসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছে পাঁচ সদস্যের কমিটি।

তদন্ত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুমনী আক্তার, চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার ডা. ওয়াজেদ চৌধুরী অভি, চসিকের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ আলী ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট জাহানারা ফেরদৌস।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিষু দে-কে বহিষ্কার ও তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়টি আলোকিত চট্টগ্রামকে নিশ্চিত করেন চসিকের সচিব খালেদ মাহমুদ।

পুলিশ যা বলছে…

এ ব্যাপারে খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহীনুজ্জামান বলেন, রোববার এমডি হাসান নিজের ফেসবুক আইডিতে বাসায় বসে করোনার টিকা গ্রহণের ছবি পোস্ট করেন। ঊর্ধ্বতন স্যারদের নির্দেশনায় রোববার রাতেই খুলশীর জাকির হোসেন রোডের বাসা থেকে হাসানকে আটক করি। পরে তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সোমবার সকালে মোবারক আলীকেও আটক করেছি। এ চক্রের অন্যদের আটকে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (উত্তর) আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, হাসানের সঙ্গে সাজ্জাদ নামে তার এক বন্ধুও বাসায় বসে ভ্যাকসিন নিয়েছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে আমরা জানতে পেরেছি। তাদের সহযোগিতা করেছেন মোবারক আলী নামে এক ব্যক্তি। তাকে ইতোমধ্যেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া অন্য আসামিকেও আটকের চেষ্টা চলছে।

জেডএইচ

আরও পড়ুন: করোনা—শনাক্তের ‘দাপট’ উত্তর চট্টগ্রামে, নগরে ফের বাড়ল মৃত্যু

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!