করোনাকালেও পথে পথে ‘অসুখের ফাঁদ’, হাসপাতালে রোগীর চাপ

সারাদেশের মতো চট্টগ্রামেও বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। নগরের হাসপাতালগুলোতে এখন করোনা রোগীদের ভিড়। এ অবস্থায়ও রাজপথে অসুখের ‘ফাঁদ’ পেতে আছেন ভ্রাম্যমাণ খাবার বিক্রেতারা। শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের অনেকেই তা কোনোরকম বাছবিচার ছাড়াই খেয়ে যাচ্ছেন। অসুখেও পড়ছেন। করোনাকালে যা বাড়তি চাপের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে নগরের হাসপাতালগুলোর জন্য।

জানা যায়, নগরে নিম্ন আয়ের মানুষের দিনের বড় একটা সময় কাটে পথে পথে। তাদের অনেকের প্রতিদিন খাবার খান ফুটপাতের ভ্রাম্যমাণ দোকানে। অবশ্য শুধু নিম্ন আয়ের মানুষই নন, চাকরিজীবী কিংবা ছোটখাটো ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার, বিভিন্ন বয়সের মানুষও ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকে অনেককিছু খান। এসব খাবারের বেশিরভাগই স্বাস্থ্যকর নয়। এরপরও এসব খাবারের দোকানে দিনভর কম-বেশি ভিড় থাকে।

১০ টাকার ‘বিরিয়ানি’

মূল পরিচিতিটা ‘কাউয়া বিরানি’ নামে! মাত্র ১০ টাকার মধ্যেই মাংস দিয়ে বিরিয়ানির স্বাদ— তাই এমন প্রশ্ন বা বিদ্রুপ ওঠাই স্বাভাবিক। এ ‘বিরিয়ানির’ মূল গ্রাহক নিম্নবিত্ত মানুষ। বিশেষ করে রিকশাচালক, দিনমজুর ও গার্মেন্টস শ্রমিক।

নগরের বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে এই খাবারের বিক্রিটা বেশ জমজমাট। একটি ভ্যানগাড়ি, একটি বড় ডেকচি, তাতে আগে থেকেই রান্না করে রাখা ‘বিরিয়ানি’, গরম করার সরঞ্জাম, প্লেট, চামচ — এই হলো বিনিয়োগ। প্রথমে শুধু ১০ টাকার ‘বিরিয়ানিই’ বিক্রি হতো। এখন ১০, ১৫, ২০ এমনকি ৫০ টাকাতেও অনেক জায়গায় ‘বিরিয়ানি’ বিক্রি হয়।

দেখতে অনেকটা আসল বিরিয়ানির মতোই; বিরিয়ানির সুবাসও মেলে খানিকটা, সঙ্গে টুকরো করা আলু, আর থাকে ছোট ছোট টুকরোয় ‘মাংস’। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে— ১০ টাকার মধ্যে মাংস কীভাবে দেন তারা? মাংসটা কীসের? উত্তরটা জানা যায়নি। তবে নামটাই সম্ভবত অনেক কিছুর ইঙ্গিত দেয়— ‘কাউয়া বিরানি’!

ভাজাপোড়া, চটপটি-ফুচকা

ছোলা, পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ, শাকভাজি… না, কোনো ফাস্টফুডের দোকানের মেন্যুর কথা বলা হচ্ছে না। এটা হলো নগরের বিভিন্ন পয়েন্টে ভ্যানগাড়িতে বিক্রি করা ‘চনা-পেঁয়াজুর’ ভ্রাম্যমাণ দোকানের কথা। ভালো পয়েন্টে জমিয়ে বসতে পারলে মধ্যবিত্ত, এমনকি উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষকেও খদ্দের হিসেবে পাওয়া যায়।

মূলত নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষই এসব ‘ভাজাপোড়ার’ গ্রাহক। তবে বিকেলের নাস্তা বা সন্ধ্যার আড্ডায় এসব ভ্রাম্যমাণ দোকানের ক্রেতা হয়ে যান চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, ছাত্রসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ।

আন্দরকিল্লা থেকে শুরু করে চেরাগী পাহাড়, নিউমার্কেট, বহদ্দারহাটসহ নগরজুড়ে আছে এসব খাবার। এ ভাজাপোড়া তৈরিতে ব্যবহৃত তেলসহ অন্যান্য উপাদানের বেশিরভাগই অত্যন্ত নিম্নমানের। রন্ধন ও পরিবেশন প্রক্রিয়াও অস্বাস্থ্যকর। চিকিৎসকদের মতে, এসব খাবার স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর।

এর বাইরে নগরের বিভিন্ন স্থানে ভ্যানগাড়িতে বিক্রি হওয়া চটপটি ও ফুচকার রন্ধন এবং পরিবেশন প্রক্রিয়াও যেকোনো সচেতন মানুষকে উদ্বিগ্ন করার জন্য যথেষ্ট। তারপরও নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত— সব শ্রেণির মানুষই ফুটপাতের এসব অস্বাস্থ্যকর চটপটি আর ফুচকা খেয়ে যাচ্ছেন।

শরবত চিড়া আখের রস

গরমে তৃষ্ণায় একটু গলা ভেজাতে কে না চায়। সে চাহিদার কথা মাথায় রেখে নগরের বিভিন্ন স্থানে ভ্যানগাড়িতে বিক্রি হয় নানারকম পানীয়। এসব পানীয়ের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন স্বাদের শরবতও। এ শরবতের বেশিরভাগই আবার স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব পানীয় পানিবাহিত রোগের বাহক।

মৌসুমি ফল

আম, জাম, কলা, লিচু, কাঁঠাল, আনারস, তরমুজ, পেঁপে, পেয়ারাসহ হরেকরকম ফলের স্বাদ অনেকেই চলতিপথে নিয়ে থাকেন। ছোট ছোট টুকরো করে কেটে প্লেটে সাজিয়ে খোলা অবস্থাতেই রেখে দেওয়া হয় বিক্রির জন্য। মূল ক্রেতা অবশ্য নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ। সচেতন মহল বলছে— স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী ফল। তবে পরিবেশন ও সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার কারণে বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ এসব ফল।

ফুটপাতেই হালিম-কাবাব!

চমকে যাবেন না, ফুটপাতে হালিম বা কাবাবের মতো খাবারও বিক্রি হয়। তবে হালিমের দামটা যখন প্রতি প্লেট ১০ টাকা, তখন মান সম্পর্কে সহজেই ধারণা করে নেওয়া যায়। বহদ্দারহাট, নিউমার্কেটসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় পাওয়া যায় ‘হালিম’ ও ‘কাবাব’।

স্বাস্থ্যঝুঁকি

ফুটপাত বা চলতিপথের খাবার স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। একেতো ধুলাবালি, তারওপর এসব খাবার তৈরিতে যেসব উপাদান ব্যবহৃত হয় তার প্রভাবে শরীরে বড় ধরনের রোগ বাসা বাঁধতে পারে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, ফুটপাতের খোলা খাবার খেলে, বিশেষ করে ভাজাপোড়া ও শরবত জাতীয় খাবারের মাধ্যমে শরীরে জন্ডিস, টাইফয়েড, গ্যাস্ট্রিক, কিডনির সমস্যাসহ নানা রোগের সংক্রমণ হতে পারে। করোনাকালে এসব রোগের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক থাকা দরকার।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর ও কোভিড-১৯ (ইআরপিপি) প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক ডা. মো. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, করোনাকালে এমনিতেও হাসপাতালে রোগীর ভিড় বেশি। তারওপর ফুটপাতের অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। করোনা রোগীদের পাশাপাশি এসব রোগীকেও সেবা দিতে গিয়ে হাসপাতালে চাপ বাড়ছে।

তিনি বলেন, ফুটপাতের অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে ডায়রিয়া, পেটের পীড়াসহ অনেক ধরনের অসুখ হতে পারে। তাই সব ধরনের অস্বাস্থ্যকর খাবার বর্জন করতে হবে। এ বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। আপনারা মিডিয়ায় লিখতে পারেন। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমেও প্রচারণা চালানো যায়।

এ ব্যাপারে প্রশাসনের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ ধরনের অস্বাস্থ্যকর খাবার বিক্রি বন্ধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো দরকার। স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও প্রয়োজনে কঠিন হতে হবে।

আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!