৩ কারণে রক্ত ঝরছে চট্টগ্রাম কলেজে

আধিপত্য বিস্তারের উত্তাপে ফের রক্ত ঝরেছে চট্টগ্রাম কলেজ ক্যাম্পাসে। ক্যাম্পাসের মধ্যেই এখন পুলিশ ফাঁড়ি, তালা ঝুলছে অধিকাংশ ছাত্রাবাস ও ফটকে, চলছে করোনার ছুটিও। এরমধ্যেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ফের খবরের শিরোনামে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী এ বিদ্যাপীঠ।

বরাবরের মতোই এবারও সংঘর্ষের ঘটনায় পরস্পরের ‍ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করেছেন কলেজ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি মাহমুদুল করিম চকবাজার এলাকার কথিত যুবলীগ নেতা নুর মোস্তফা টিনু ও তার অনুসারীদের এ ঘটনার জন্য দায়ী করেছেন। অন্যদিকে একই কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুভাষ মল্লিক সবুজ এ সংঘর্ষের জন্য দোষ দিচ্ছেন সভাপতির অনুসারীদের।

এদিকে কেন্দ্রীয় ও নগর ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এ সংঘর্ষের নেপথ্যে তিনটি কারণ উঠে এসেছে। কলেজ ক্যাম্পাসে বহিরাগত, মূল দুই গ্রুপ ছাড়াও একাধিক উপগ্রুপের রাজনীতি, ছাত্রশিবিরসহ অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ— এ তিন কারণকেই দায়ী করছেন নেতারা।

বহিরাগত ‘উৎপাত

চট্টগ্রাম কলেজে চকবাজার এলাকার বহিরাগতদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার অভিযোগ অনেকদিনের। এক্ষেত্রে বারবার আলোচনায় আসে চকবাজারের কথিত যুবলীগ নেতা নুর মোস্তফা টিনুর নাম।

গত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে জামিনে মুক্ত হন টিনু। এরপর থেকেই তার অনুসারীরা চকবাজার এলাকায় আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। চকবাজারের কাউন্সিলর সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টুর মৃত্যুর পর কাউন্সিলর নির্বাচনে প্রার্থিতার ক্ষেত্রেও আলোচনায় উঠে আসে টিনুর নাম। নির্বাচনকে ঘিরে এলাকায় প্রভাব বিস্তারে চট্টগ্রাম কলেজে ফের চোখ পড়েছে টিনুর— এমনটাই অভিযোগ বিরোধীদের।

ছাত্রলীগ নেতারা বলছেন, ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার কারণে অনেকক্ষেত্রে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে বহিরাগতদের দেশি অস্ত্র নিয়ে অংশগ্রহণ ও মহড়া চালানোর অভিযোগও রয়েছে। কলেজে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তাই ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দিয়েছেন নেতারা।

জানা যায়, চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সুভাষ মল্লিক সবুজ ক্যাম্পাসে টিনুর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। কলেজ ছাত্রলীগের একটি অংশের নেতৃত্বেও আছেন সবুজ।

দুই গ্রুপের রাজনীতিতে আছে উপগ্রুপও

নগর আওয়ামী লীগের মতোই চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের রাজনীতিতেও প্রধান দুটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারীরা।

চট্টগ্রাম কলেজেও ছাত্রলীগের এই দুটি গ্রুপের অস্তিত্ব রয়েছে। এর বাইরে কলেজে ছাত্রলীগের বেশ কয়েকটি উপগ্রুপও রয়েছে।

জানা যায়, বর্তমানে কলেজ ছাত্রলীগে কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক উপ-অর্থ বিষয়ক সম্পাদক হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর, সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দুই সাবেক সহসম্পাদক সাইফুল আলম লিমন ও ইয়াসিন আরাফাত এবং কথিত যুবলীগ নেতা নুর মোস্তফা টিনুসহ বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতার অনুসারীরা সক্রিয় রয়েছেন।

বিভিন্ন সময় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এসব গ্রুপ-উপগ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘটিত এসব সংঘর্ষে হামলা, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, মারধরের সঙ্গে চলে গ্রুপভিত্তিক মহড়াও। এতে সুযোগ বুঝে যোগ দেয় বহিরাগতরা।

পরিচয় পাল্টে ছাত্রলীগে

নগর ছাত্রলীগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাংগঠনিক সম্পাদক আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, সংগঠনে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। শিবিরের নেতা-কর্মীরাও এখন ছাত্রলীগে যুক্ত হচ্ছেন। চট্টগ্রাম কলেজে সংঘর্ষের পেছনে দলবদল করা এসব নেতাদের ভূমিকা থাকতে পারে।

তবে নগর ছাত্রলীগের সাবেক এক শীর্ষ নেতা বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, একসময় শিবিরের কিছু নেতা-কর্মী ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করেছিল। তবে এখন তা অনেকটাই কমে এসেছে।

নেতারা যা বললেন…

জানতে চাইলে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত, নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, চট্টগ্রাম কলেজে বারবার সংঘর্ষ হচ্ছে মূলত বহিরাগতদের কারণে। আমরা সবসময়ই বলেছি ছাত্রদের হাতেই ছাত্ররাজনীতি থাকতে হবে।

তিনি বলেন, আপনারা ভুল একটা বিষয় উল্লেখ করেন। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ বলেন। আসলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে তো নয়, রাস্তার রাজনীতি যারা করে, সেই বহিরাগতরা যদি কলেজে এসে রাজনীতি করতে চায়, তাহলে তো সংঘর্ষ হবেই।

কার অনুসারীরা ক্যাম্পাসে এ ধরনের অস্থিতিশীলতা তৈরি করছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার কথা আপনারাও জানেন। টিনুর (নুর মোস্তফা টিনু) অনুসারীরা যদি কলেজে এসে মারামারি করে, মাদক ব্যবসা করে, তাহলে তো এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই পারে।

চট্টগ্রামে আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসম্পাদক ইয়াসিন আরাফাত আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম কলেজে বহিরাগতদের প্রবেশের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছি। আমরা এ বিষয়ে কলেজ অধ্যক্ষকে জানিয়েছি, প্রশাসনকে জানিয়েছি। কিন্তু কলেজে বহিরাগত প্রবেশ বন্ধ হয়নি।

তিনি বলেন, চট্টগ্রামের মেধাবী শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রাম কলেজে পড়েন। অন্যদিকে বহিরাগতরা অনেক সময় ক্যাম্পাসে এসে তাণ্ডব চালান। মেধাবীরা তো বহিরাগতদের এসব কর্মকাণ্ড মেনে নিতে পারেন না। যেকারণে অনেক সময় সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়।

ইয়াসিন আরাফাত বলেন, আমরা চাই কলেজে সুস্থ ছাত্ররাজনীতি হোক। প্রতিযোগিতা হোক মেধাভিত্তিক। তাই আমাদের দাবি, চট্টগ্রাম কলেজে বহিরাগত অনুপ্রবেশ বন্ধ করা হোক।

জেডএইচ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!