সীতাকুণ্ডে ভয়াবহ বিস্ফোরণে শঙ্কায় আনোয়ারা

ভয়াবহ বিস্ফোরণর ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে। যে বিস্ফোরণে নিহত হয় প্রায় অর্ধশত মানুষ, আহত হন দুই শতাধিক। এর আগে বিস্ফোরণের ঘটনায় দেশে এত লম্বা লাশের সারি হয়নি।

দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা একটি শিল্পায়ন এলাকা। এখানে রয়েছে চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল), কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড, ইউনাইটেড বিদ্যুৎকেন্দ্র, ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) সার কারখানা ও গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)। এসব কারখানায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আগে কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়ানো জরুরি বলে মনে করছেন সচেতন মহল।

বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনার পর থেকেই আনোয়ারার সচেতন মহল সতর্ক হওয়ার জন্য এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সচেতন মহল মনে করে, এসব কারখানাতে কোনও ত্রুটির কারণে যদি বিস্ফোরণ হয় তাহলে আনোয়ারা লেবাননের বৈরুত কিংবা সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপো হবে।

রসায়নবিদদের মতে, ইউরিয়া উৎপাদনে প্রায় ১২০-১৩০ এটিএম চাপে ও ১৮০-১৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এনএইচ৩ ও সি০২ গ্যাসের বিক্রিয়ায় প্রথমে অ্যামোনিসাম কারামেট এবং পরে এটি নিদিত হয়ে ইউরিয়া উৎপন্ন করে। অ্যামোনিয়াম উৎপাদনে নাইট্রাজেন ও হাইড্রোজেনে ১:৩ অনুপাতের মিশ্রণটিকে ৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উত্তপ্ত এফই চূর্ণ ও প্রভাবক সহায়ন এ১২০৩ মিশ্রণের ওপর দিয়ে ২০০ এটিএম চাপে চালনা করলে হেবার পদ্ধতিতে অ্যামোনিয়া উৎপন্ন হয় এবং অ্যামোনিয়াম থেকে সি০২ এর বিক্রিয়া করে ইউরিয়া সার তৈরি হয়।

২০১৬ সালে ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি-১) সার কারখানায় একটি অ্যামোনিয়া গ্যাসের ট্যাংক ছিদ্র হয়ে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এতে ট্যাংকটি অন্তত ৫০ ফুট দূরে উড়ে গিয়ে পড়ে। এতে নির্গত হয়ে যায় ট্যাংকের প্রায় ৪০০ টন অ্যামোনিয়া গ্যাস। ফলে আনোয়ারা উপজেলাসহ আশপাশের পতেঙ্গা, হালিশহর, ইপিজেড, আগ্রাবাদ পর্যন্ত প্রায় কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বাতাসের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে দুর্গন্ধযুক্ত অ্যামোনিয়া গ্যাস। এতে অ্যামোনিয়ার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দুই শতাধিক মানুষ শ্বাসকষ্টে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল।

আশপাশের নদী, পুকুর ও জলাশয়ের মাছ ও পশু-পাখিসহ মারা যায় বিপুল সংখ্যক প্রাণী। ক্ষতিগ্রস্ত হয় খেতের ফসল। বিবর্ণ হয়ে পড়ে গাছপালা। চলতি বছরের গত ২৪ এপ্রিল চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) বর্জ্যের বিষাক্ত পানি পান করে ১৩ মহিষের মৃত্যুর ঘটে।

এর আগে ১৪ এপ্রিল ৪টি এবং সর্বশেষ ৬ মে ৮টি মহিষের মৃত্যু হয়। এভাবে প্রতিবছর সিইউএফএলের বর্জ্যের বিষাক্ত পানি খেয়ে অনেক গবাদিপশু মারা যায়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল হোসেন আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, ইউরিয়া উৎপাদনে যে রাসায়নিক ব্যবহার হয় তা এমনিতে পরিবেশের জন্য বিপর্যয়। যা ইটিপি প্লান্টের মাধ্যমে পরিশোধন করতে হয়। তা না হলে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় হয়। এসব কারখানাতে যে রাসায়নিক মজুদের ডিপো বা সঞ্চালন লাইন রয়েছে তা যদি দুর্ঘটনা রোধে সক্ষম না হয় তাহলে যেকোনো সময় বড় বিপর্যয় ঘটবে।

তিনি বলেন, এমনিতে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট নিজে কোনো বিস্ফোরক পদার্থ নয়, তবে বিশেষ কিছু অবস্থায় তা বিস্ফোরকে পরিণত হতে পারে। তখন যে বিপর্যয় হবে তা বৈরত কিংবা সীতাকুণ্ড বিস্ফোরণের থেকে ভয়াবহ হবে। এজন্য কর্তৃপক্ষকে এখন থেকে সর্তক থাকতে হবে। তা না হলে এসব কারখানাতে যেকোনো সময় মারত্মক বিস্ফোরণ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান এমএ কাইয়ুম শাহ সীতাকুণ্ড ট্রাজেডির কথা উল্লেখ করে বলেন, ভয় হয় প্রাণের আনোয়ারা কখন সীতাকুণ্ড হয়! আমরা আর লাশ দেখতে চাই না, চাই না শত মায়ের বুক খালি হোক। চাই না সদ্য জন্মানো শিশুর মুখ দেখার আগেই কোনো বাবার মৃত্যু হোক। বিস্ফোরণ হওয়ার পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ চাই না, আমরা চাই দুর্ঘটনা ঘটার আগে আপনারা পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। নয়ত আবার লাশের মিছিল দেখতে হবে।

তিনি বলেন, সিইউএফএল, ড্যাপ-১, ড্যাপ-২, কাফকোসহ আনোয়ারায় অবস্থিত সব কারখানা নজরদারির মধ্যে এনে যেকোনো দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাচ্ছি। এছাড়া এ বিষয়ে আনোয়ারা-কর্ণফুলীর অভিভাবক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

এদিকে নিরাপত্তার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আনোয়ারায় অবস্থিত এসব কারখানার একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, কারখানার নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিয়ে আমরা খুবই সচেতন রয়েছি। এসব বিষয়ে সবসময় আমরা বিসিআইসির নির্দেশনা মেনে থাকি। কারখানার সেফটি বিভাগ সবসময় সতর্ক অবস্থানে কাজ করে থাকে।

আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!