‘মরণফাঁদ’ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নালা—গিলে খেল ৭ প্রাণ

পথে পথে মরণফাঁদ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) খোলা নালাগুলো। একে একে ৭ প্রাণ গিলে খেয়েছে এসব নালা। কোনো মৃত্যুই দায়িত্বশীলতার টনক নড়েনি চসিকের। তবে নালায় পড়ে মৃত্যুর পর শোকার্ত পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে ছুটে যান চসিক মেয়র। কাউকে ৫০ হাজার টাকা কিংবা চাকরির আশ্বাস দিয়ে ফেরা হয় চসিক মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরীর।

এদিকে নগরের উত্তর আগ্রাবাদের রঙ্গিপাড়ায় নালায় পড়ে দেড় বছরের শিশু ইয়াছিন আরাফাতের মৃত্যুর দুদিন পার হলেও নিহত পরিবারের কাছে যাননি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। তবে নিহতের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা আর্থিক সহযোগিতা পাঠিয়েছেন তিনি।

অপরদিকে নিহতের পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে স্থানীয় কাউন্সিলর নাজমুল হক (ডিউক) ও চট্টগ্রাম –১০ আসনের সংসদ সদস্য মো. মহিউদ্দিন বাচ্চু গেছেন। তবে মেয়র না যাওয়ায় এলাকায় উঠেছে সমালোচনার ঢেউ। টাকা দিয়ে দায় সেরেছে সিটি করপোরেশন—এমনও মন্তব্য করেছেন স্থানীয় মানুষ।

শিশু মৃত্যুর পরও টনক নড়েনি চসিকের। এখনও অরক্ষিত রঙ্গিপাড়ার নালার সেই অংশ। অরক্ষিত অংশের কাজ কবে করা হবে তারও সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য নেই চসিকের কাছে। এ নিয়ে ক্ষুদ্ধ ওই এলাকার মানুষ।

নগরে নালায় পড়ে মৃতের ঘটনা নতুন কিছু নয়। এর আগেও একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। সিটি করপোরেশনের উদাসীনতায় উন্মুক্ত নালা, খালে পড়ে হতাহতের সংখ্যা বাড়ায় ক্ষোভে ফুঁসছে নগরবাসী।

অনুসন্ধান বলছে, চসিকের নালায় পরে এ পর্যন্ত ৭ জন প্রাণ হারিয়েছে। ৭ আগস্ট নগরের ১ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের ফতেহপুর ইসলামিয়া হাট সংলগ্ন বাদামতলা এলাকার নালায় পড়ে মারা যান কলেজছাত্রী নিপা পালিত। এর আগে ২০২১ সালের ৩০ জুন ষোলশহর এলাকার চশমা খালে পড়ে অটোরিকশাচালক ও এক যাত্রীর মৃত্যু হয়। একই বছর ২৫ আগস্ট সকালে মুরাদপুরে ড্রেনে পড়ে নিখোঁজ হন ব্যবসায়ী সালেহ আহমেদ। বছর পেরিয়ে গেলেও আজও তার লাশের হদিস মিলেনি।

আরও পড়ুন : চট্টগ্রামে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিল কলেজছাত্রী, নালায় পড়ে মুহূর্তেই লাশ

এছাড়া ২০২২ সালের ৬ ডিসেম্বর একই খালে তলিয়ে যায় শিশু মো. কামাল উদ্দিন। তিনদিন পর মির্জা খাল থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর আগ্রাবাদের মাজার গেট এলাকার ফুটপাতে পা পিছলে নালায় পড়ে মৃত্যু হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়ার।

জানা যায়, অতীতেও নালায় পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়েছে এবং উচ্চ আদালতে রিটের পর নির্দেশনাও দেওয়া হয়ছে। কিন্তু নির্দেশনার তোয়াক্কা করেনি চসিক।

সর্বশেষ গত ২৭ আগস্ট বিকেল সাড়ে চারটার দিকে খেলতে গিয়ে রঙ্গিপাড়া নালায় পড়ে নিখোঁজ হয় শিশু ইয়াসিন আরাফাত। নিখোঁজের পরদিন সকাল ৯টার দিকে আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল, চসিকের পরিচ্ছন্নতা বিভাগের লোকজন এবং পুলিশের সহায়তায় ঘরের সামনে নালার আবর্জনার স্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয় ওই শিশুর নিথর দেহ৷ সন্তান হারিয়ে এখন পাগলপ্রায় মা নাসরিন আক্তার ও বাবা সাদ্দাম হোসেন।

শিশুর খালা পাখি আক্তার আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, আরাফাতের মা গৃহিণী। বাবা ব্রাক্ষণবাড়িয়া নবীনগরে রাজমিস্ত্রীর কাজ করে। ভালোই চলছিল তাদের পরিবার। সন্তান হারিয়ে এখন তারা পাগলপ্রায়। চসিক থেকে ৫০ হাজার এবং চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন থেকে ২৫ হাজার টাকা দিয়েছে। টাকা দিলে কি আর ইয়াসিনকে পাওয়া যাবে? এই নালা আগে থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। চসিকের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা কখনও পরিষ্কার করতে আসেনি।

উত্তর আগ্রাবাদ রঙ্গিপাড়া এলাকার বাসিন্দা আবুল কালাম আজাদ ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, এই নালা গত দুই–তিন বছরে একবারও পরিষ্কার করা হয়নি। শিশু নিখোঁজের পর উদ্ধারকাজ চালাতে বেশ কষ্ট হয়েছে। ময়লা-আবর্জনায় ঠাসা ছিল নালা।

এদিকে একটু বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যায় নগরের নিঁচু এলাকা। দেখা দেয় ভয়াবহ জলাবদ্ধতা। ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাসা-বাড়ি, দোকানপাট ও রাস্তাঘাট। খোদ নগরপিতার বাড়িও ডুবে যায় জলাবদ্ধতায়৷ চসিকের আওতাধীন নগরের অধিকাংশ নালা–নর্দমা অরক্ষিত হয়ে মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে ৷ সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ না থাকায় বিপজ্জনক এসব নালায় পড়ে ঘটছে প্রাণহানির মতো ঘটনা। এরপরও ঘুমিয়ে আছে চসিক।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামে মোট খাল রয়েছে ৫৭টি। এর মধ্যে ৩৬টি খালের দায়িত্বে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) এবং বাকি ২১টি যেগুলো টারশিয়ারি খাল নামে পরিচিত সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব চসিকের। এসব খালের অধিকাংশ এখন ময়লা আবর্জনায় ভরাট হয়ে আছে। নেই স্ল্যাব ও সংরক্ষিত দেয়াল। ফলে যেকোনো সময় ঘটতে পারে প্রাণহানির মতো ঘটনা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তর আগ্রাবাদ ২৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নাজমুল হক (ডিউক) আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, নালাগুলো পরিষ্কার করা হয়। কিন্তু জনগণের ফেলা ময়লা বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে ফের জমাট হয়। অরক্ষিত যেসব জায়গায় স্ল্যাব বসাতে হবে সেগুলো আমরা করে দেব। তবে ওই শিশুর মৃত্যুর পেছনে পরিবারেরও দায় রয়েছে। আমি দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থলে গিয়েছি এবং চসিকের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।

চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

পরে মেয়রের একান্ত সচিব ও পরিচ্ছন্নতা বিভাগের প্রধান মু. আবুল হাশেমের সঙ্গে যোগাযোগ চেষ্টা করা হলে সাড়া দেননি তিনিও।

যোগাযোগ করা হলে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মু. তৌহিদুল ইসলাম আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, রঙ্গিপাড়ায় শিশু মৃত্যুর ঘটনায় আমরা দুঃখপ্রকাশ করেছি। এ ঘটনায় পুরোপুরি সিটি করপোরেশনকে দায়ী করা যাবে না। কারণ দেড় বছর বয়সী বাচ্চার দেখভাল করার দায়িত্ব তার মায়ের। বাচ্চাটি যেদিন নালায় পড়ে ডুবে গেছে সেদিন অনেক বৃষ্টি হয়েছে। এদিন মায়ের উচিত ছিল বাচ্চাকে দেখে রাখা। কারণ নালায় না পড়ে রাস্তায় এক্সিডেন্ট হয়েও তো দুর্ঘটনা হতে পারতো।

আরও পড়ুন : চট্টগ্রামে এবার নালায় পড়ে নিখোঁজ শিশু, খুঁজছে দমকল কর্মীরা

রঙ্গিপাড়ার অরক্ষিত নালা কবে ঠিক করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মেয়র মহোদয় এ ব্যাপারে খুবই সচেষ্ট। তিনি আমাদের বলেছেন এ ধরনের কোনো নালা যেন অরক্ষিত না থাকে। তিনি যেহেতু বলেছেন এটি অবশ্যই দ্রুততম সময়ে করা হবে।

অরক্ষিত নালা-নর্দমার বিষয়ে তিনি বলেন, নালা-নর্দমা পরিষ্কারের একদিন পর সাধারণ মানুষ আবার নালায় ময়লা ফেলে। এতে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ আটকে যায়। এক্ষেত্রে জনগণেরও দায় রয়েছে। প্রতিদিন আমাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাজ শেষ হলে আমাদের আওতার কোন কোন জায়গা বা নালা অরক্ষিত রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নিহতের পরিবারের কাছে মেয়রের না যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মেয়র মহোদয় এ ঘটনার পর দুঃখপ্রকাশ করেছেন। চসিকের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা আর্থিক সহযোগিতা করা হয়েছে৷ মেয়রের একান্ত সচিব সেখানে গেছেন। এছাড়া স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও চট্টগ্রাম-১০ আসনের সংসদ সদস্যও গেছেন। মেয়র সবসময় যেতে পারবেন তাও কিন্তু নয়।

আরবি/আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!