পতেঙ্গা সৈকতে অবৈধ দোকানের ছড়াছড়ি, পথে পথে চাঁদাবাজি

চট্টগ্রাম নগরের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পর্যটনকেন্দ্রর মধ্যে অন্যতম পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত (সি-বিচ)। ছুটির দিনে অবসাদ কাটাতে এখানে সমাগম ঘটে লাখো পর্যটকের। তবে পতেঙ্গা সৈকতে পর্যটদের জন্য ৩০ ফুট ওয়াকওয়ে নির্মাণ করলেও তার পুরোটাই এখন হকারদের দখলে।

পাঁচ শতাধিক অবৈধ স্থাপনার করণে পর্যটকদের পা রাখার ঠাঁই নেই পতেঙ্গা সৈকতে। এসব অবৈধ স্থাপনা বসানোর নেপথ্যে রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালী দুগ্রুপ। মাসে এখান থেকে চাঁদা ওঠে ২০ লাখের বেশি। যার ভাগ যায় ট্যুরিস্ট পুলিশ ও স্থানীয় নেতাদের পকেটে।

অভিযোগ আছে, ট্যুরিস্ট পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের ছত্রছায়ায় পতেঙ্গা সৈকতে এসব অবৈধ স্থাপনা বসিয়েছে এলাকার প্রভাবশালীরা। এখান থেকে চাঁদা তোলে দুটি গ্রুপ। এর মধ্যে একটি গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন ‘পতেঙ্গা সৈকত দোকান মালিক সমিতি’র নামে ওয়াহিদুল আলম ওরফে ওয়াহিদ মাস্টার এবং ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা মাইনুল ইসলাম ও তাজু।

একইসঙ্গে ‘পতেঙ্গা সৈকত হকার্স সমিতি’র নামে টাকা তোলেন নুর মোহাম্মদ ও শাহাব উদ্দিন।

 

জানা গেছে, পতেঙ্গা সৈকতে গড়ে ওঠা পাঁচ শতাধিক স্থাপনার প্রতিটি থেকে প্রাথমিকভাবে এককালীন চাঁদা নেয় স্থানীয় গ্রুপ দুটি। প্রতিটি স্থাপনা থেকে এ চাঁদার পরিমাণ দোকানভেদে ১০ হাজার থেকে লাখ টাকা! এ হিসাবে এককালীন তোলা চাঁদার পরিমাণ কোটি টাকারও বেশি। এছাড়া প্রতিটি স্থাপনা থেকে দৈনিক ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হয়। এ হিসাবে মাসে চাঁদা ওঠে প্রায় ২০ লাখ টাকা। চাঁদার এই টাকা দুগ্রুপের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হয়। আবার এর বড় একটি অংশ যায় পতেঙ্গা সৈকত ট্যুরিস্ট পুলিশসহ স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের পকেটে। চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করার কথা স্বীকারও করেছেন দোকানিরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন দোকানি জানান, গত ২০ বছর ধরে আমরা সি-বিচে (পতেঙ্গা সৈকত) ব্যবসা করছি। আগে কাউকে চাঁদা দিতে হয়নি। এখন দোকান করতে গেলে ওয়াহিদ মাস্টার গ্রুপ ও নুর মোহাম্মদ গ্রুপকে চাঁদা দিতে হয়। কয়েক বছর ধরে হকারদের কাছ থেকে এই দুগ্রুপ চাঁদাবাজি করে আসছে। তাদের টাকা না দিয়ে এখানে দোকান বসানো যায় না। সবাইকে এককালীন টাকা দিয়ে এখানে বসতে হয়। এছাড়া দোকানের আকারভেদে দিনে ১শ থেকে ৩শ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। কখনো কখনো এক হকার থেকে দুগ্রুপই টাকা নিয়ে যায়।

দোকানিরা আরও জানান, এখানে দুটি সমিতির নাম ব্যবহার করা হলেও মূলত প্রশাসনসহ গুটিকয়েক মানুষের পকেটে যায় চাঁদাবাজির টাকা। ওয়াহিদ মাস্টার, মাইনুল ইসলাম, তাজু, নুর মোহাম্মদ, শাহাব উদ্দিনসহ যুবলীগ নামধারী কয়েকজন জড়িত এই চাঁদাবাজিতে। এখান থেকে ট্যুরিস্ট পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন মোটা অঙ্কের মাসোহারা পায়।

বন্দরটিলা থেকে সপরিবারে বেড়াতে আসা আবু খালেদ বলেন, ‘এক সময় সি-বিচে আসলে অনেক ভালো লাগতো। কিন্তু এখন মনে হয় কোনো মেলায় এসেছি। যেদিকে যাই, শুধু হকার আর হকার। যেখানে পর্যটকের নিরাপত্তা ও নির্বিঘ্নে ভ্রমণ নিশ্চিত করার কথা পুলিশের, সেখানে দেখা যায় তারাই বিভিন্ন নামে ওয়াকওয়ে দখল করে দোকান খুলে বসে আছে। এখন বেড়াতে আসলে তেমন কোথাও হাঁটা-চলা করি না। পরিবার পরিজন নিয়ে কিছুক্ষণ এক জায়গায় বসে চলে যাই।’

অহিদুল আলম নামের একজন জানান, এখানে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) কেন শত কোটি টাকা খরচ করলো বুঝলাম না। পর্যটকদের চলাচলের জন্য পাঁচ কিলোমিটার জুড়ে ৩০ ফুটের মতো ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হলেও তা পর্যটকদের কোনো কাজে আসছে না। সি-বিচের পুরো ওয়াকওয়ে হকারদের দখলে। নিচে চলাচলে সামন্য একটু জায়গা থাকলেও, সেখানেও দেখছি দোকানদাররা চোয়ার বিছিয়ে দিয়েছে। কোথাও হাঁটার একটু জায়গা নেই। এর চাইতে ভালো হতো পুরো সি-বিচ কাউকে লিজ দিয়ে দিলে। তাতে সরকারও কিছু টাকা রাজস্ব পেতো, সি-বিচের পরিবেশটাও ভালো হতো। কিছুদিন আগে শুনেছিলাম পতেঙ্গা সৈকত লিজ দিচ্ছে সিডিএ। এখন দেখছি তাও হচ্ছে না।

এদিকে দোকানিদের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ওয়হিদুল আলম ওরফে ওয়াহিদ মাস্টার। তিনি আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, আমরা কারো কাছ থেকে চাঁদা নিই না। এখানে সবাই যার যার মতো দোকান নিয়ে বসেছে। সমিতির জন্য নামমাত্র কিছু টাকা নেওয়া হয়।

দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হয়ে হকারদের কাছ থেকে ওয়াহিদ মাস্টার চাঁদা তোলেন—জানিয়ে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত হকার সমিতির সভাপতি নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘চাঁদাবাজি আমি করি না, করেন ওয়াহিদ মাস্টার। এ ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে আমার তিনটি চাঁদাবাজি মামলা রয়েছে। আমরা সমিতির জন্য সামান্য টাকা নিই। মূলত এখানকার সব চাঁদাবাজিতে ওয়াহিদ মাস্টার জড়িত।

এদিকে অভিযোগের বিষয়ে পতেঙ্গা সৈকত ট্যুরিস্ট পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) ইস্রারাফিল মজুমদার বলেন, চাঁদাবাজির সঙ্গে ট্যুরিস্ট পুলিশ কোনোভাবেই জড়িত নয়। কাউকে চাঁদা না দিতে আমরা লিফলেট বিতরণ করেছি। কেউ চাঁদা দাবি করলে, আমাদের জানাতে বলেছি। ট্যুরিস্ট কেন্টিনের টাকা আমাদের কল্যাণ তহবিলে জমা হয়। আর তা মানুষের চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় না।

তিনি আরও বলেন, আমি যতদূর জানি তারা দুটি রেজিস্টার্ড সংগঠন। আমরা তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। চাঁদাবাজির বিষয়ে উভয় সংগঠনকে সতর্ক করেছি। তাদের সংগঠনের জন্য সামান্য মাসিক চাঁদা নেয় বলে জানি। এর বেশি কিছু আমাদের জানা নেই।

এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পতেঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু জায়েদ মো. নাজমুন নুর বলেন, আমি এ থানায় এসেছি চার মাস হয়েছে। আমি এবং আমার থানার কোনো অফিসার ওখানকার চাঁদাবাজিতে সম্পৃক্ত নয়। আপনি গোপনে খবর নিতে পারেন, আমি অথবা আমার থানার কোনো অফিসার টাকা নিই কি-না? আমি নিশ্চিত এ ধরনের কোনো অভিযোগ আপনি পাবেন না।

তিনি আরও বলেন, সিডিএ বা অন্য কোনো সংস্থা এখানে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করলে আমার শতভাগ সহযোগিতা থাকবে। এছাড়া পতেঙ্গা সৈকতে চাঁদাবাজির অভিযোগ কেউ করলে আমি সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশনে যাব।

এ বিষয়ে জানতে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসেরের মুঠোফোনে একধিকবার কল করা হলেও ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

এছাড়া সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষের মুঠোফোনে একধিকবার যোগাযোগের চেষ্ট করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি।

আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!