চট্টগ্রামে চাঁদাবাজি করে টাকার পাহাড়, মোহরা ‘শ্রমিক লীগ’ নেতা বানিয়েছেন দেড় কোটির বাড়ি

অটোরিকশা—মাসে ৬০০ ও প্রতি ট্রিপে ১০ টাকা চাঁদা নেন আবুল হোসেন

চাঁদাবাজদের সর্দার, ‘শ্রমিক লীগ নেতা’ হিসেবে পরিচিত আবুল হোসেন ওরফে হোসেন মাদক ও অস্ত্র দিয়ে এক নারীকে ফাঁসাতে গিয়ে নিজেই ধরা পড়েছেন র‌্যাবের হাতে। চান্দগাঁওয়ের মোহরা এলাকায় মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে গণপরিবহন থেকে চাঁদা আদায়, ছিনতাই চক্র পরিচালনাসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।

নগরের কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায় অটোরিকশাপ্রতি দৈনিক ৬০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেন হোসেন। এছাড়া রাঙ্গুনিয়া-রাউজান থেকে আসা অটোরিকশা থেকে প্রতি ট্রিপে নেন ১০ টাকা। এভাবে টাকার পাহাড় গড়ে চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি বানিয়েছেন তিনি।

জানা গেছে, গত মঙ্গলবার (৬ সেপ্টেম্বর) মধ্যরাতে তাঁকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-৭। বুধবার (৭ সেপ্টেম্বর) তাঁর বিরুদ্ধে মাদক ও অস্ত্র আইনে মামলা দায়ের করে হস্তান্তর করা হয়েছে নগরের চান্দগাঁও থানায়।

গ্রেপ্তার মো. আবুল হোসেন রাঙ্গুনিয়ার মরিয়মনগর ইউপি আমিন কোড়ালপাড়া গুড়া মিয়ার বাড়ির মৃত আব্দুল হাকিমের ছেলে। তিনি বর্তমানে চান্দগাঁও সিঅ্যান্ডবি গ্যাস কলোনির পাশে একটি ভবনের চতুর্থ তলার ভাড়াটিয়া।

মোহরা এলাকা স্থানীয়রা জানান, হোসেন চাঁদাবাজের সর্দার। তার বাড়ি রাঙ্গুনিয়া হলেও দাপিয়ে বেড়ান কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায়। দীর্ঘদিন ধরে পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের নাম বিক্রি করে অবৈধ অটোরিকশা স্ট্যান্ড বানিয়ে টোকেনের নামে করছেন চাঁদাবাজি। প্রশাসনের সামনে প্রকাশ্যে চলে এসব চাঁদাবাজি। কিন্তু দেখেও যেন দেখার কেউ নেই।

কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকার কয়েকজন যাত্রী জানান, কীভাবে চাঁদাবাজি হয়, তা দেখতে হলে কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলেই হবে। প্রশাসনের সামনেই চলছে এ চাঁদাবাজি। তবে এতে প্রশাসনের কোনো পদক্ষেপ নেই।

এছাড়া রেললাইন ঘেঁষে তিনি গড়েছেন টিনের ঘর। প্রতিদিন এতে বসছে জুয়া ও মাদকের আসর। তিনি টাকায় ভাড়া খাটেন বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

আরও পড়ুন: মেয়র রেজাউলের আশ্বাসেও ফইল্যাতলী বাজারে অসন্তোষ, নেপথ্যে কর্তাদের কারসাজি

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে শাহ আলম নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘টাকার বিনিময়ে হোসেনকে দিয়ে অপরাধ জগতের যেকোনো কাজ করানো যায়। তাছাড়া দুদিন আগে তিনি এমন ভাড়ায় খেটেই র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন। তাছাড়া নগর ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত নেতা ফারুকও রেললাইনের পাশের এ জুয়ার আসর থেকে দৈনিক ১ হাজার টাকা করে চাঁদা নেন।

তিনি বলেন, ফারুক মাঝেমধ্যে বিভিন্ন পত্রিকায় নিউজ করে পুলিশী হয়রানির ভয় দেখিয়েও বহদ্দারহাট ও চান্দঁগাও এলাকার আবাসিক হোটেল থেকেও চাঁদা নেন। চাঁদা না দেওয়ায় সম্প্রতি বহদ্দারহাটের এক ব্যবসায়ীকে সন্ত্রাসী সাজিয়ে চট্টগ্রামের একটি আন্ডারগ্রাউন্ড পেপারে কয়েকটি ‘কথিত খবর’ ছেপে চাঁদাবাজির চেষ্টাও করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

আবুল হোসেন চোলাই মদের বাণিজ্য করেন—এমন অভিযোগ এক অটোরিকশা চালকের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘রাঙ্গুনিয়া থেকে আসা অটোরিকশার কিছু অসাধু চালকের যোগসাজশে প্রচুর পরিমাণে চোলাই মদ নগরে এনে বিক্রি করেন আবুল হোসেন। তাছাড়া গত কয়েকদিনে দুদফায় পুলিশের হাতে চোলাই মদসহ কয়েকজন অটোরিকশা চালক গ্রেপ্তার হন।

নগরের বাহির সিগন্যাল কাজিরহাট বাজার, বোর্ড স্কুল এলাকার ছিনতাই চক্র পরিচালনা করেন আবুল হোসেনের ভাগিনা মাহবুব। এ এলাকায় নিম্ন আয়ের পোশাক শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতিদিন ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা।

ইমরান হোসেন নামের এক পোশাক শ্রমিক বলেন, গত কোরবানের চারদিন আগে আমার স্মার্টফোনসহ মানিব্যাগে থাকা ৪০০ টাকা ছিনতাই করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।

হোসেনের নামে অভিযোগ দিতে গিয়ে কামাল নামের এক অটোরিকশা চালক বলেন, সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে সকল গাড়ি থেকে চাঁদা আদায় করে তার চক্র। টাকা না পেলে গাড়ি আটকে রাখাসহ মারধরের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। এতে গাড়ি মামলা (টো) দিয়ে সহায়তা করে ট্রাফিক পুলিশ। অটোরিকশাপ্রতি টোকেন বাবদ মাসিক সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে। তাছাড়া রাঙ্গুনিয়া-রাউজান থেকে আসা-যাওয়া করা প্রতিটি অটোরিকশা থেকে প্রতি ট্রিপে ১০ টাকা করে চাঁদা নেয় হোসেনের বাহিনী।

শ্রমিক লীগের নামে প্রতিদিন গাড়ি প্রতি ১০ থেকে ২০ টাকা করে চাঁদা আদায় করছে বলেও অভিযোগ তুলেছেন আরেক অটোরিকশা চালক। নাম প্রকাশ না করে তিনি বলেন, তারা ২০ থেকে ৩০ জনের একটি দল প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করে।

কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায় হোসেনের নেতৃত্বে রয়েছে বেশকিছু কথিত সাংবাদিকও। মূলত ডি দিদার, সাংবাদিক হান্নান, রিপন, ইমন, ভন্টসহ কথিত আরো অনেক অনলাইন সাংবাদিক তার অপকর্মে মদদ দেন বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকার এক চাঁদা উত্তোলনকারী বলেন, পুলিশকে ম্যানেজ করার কারণে আমাদের বসকে (হোসেন) বাধা দেয় না প্রশাসন। বসের বিশ্বস্ত হওয়ায় নাম বলতে রাজি হননি তিনি।

এদিকে চাঁদাবাজি করে আবুল হোসেন বোয়ালখালীতে দেড় কোটি টাকা খরচ করে নতুন বাড়ি নির্মাণ করেছেন বলে জানা গেছে।

হোসেনের বিষয়ে জানতে চাইলে চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাঈনুর রহমান আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, চান্দগাঁও দেওয়ান মহসীন সড়কের গোলাপের দোকান এলাকায় মো. ইউসুফ ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী কোহিনূরের যোগসাজশে হোসেন এক সহজ-সরল নারীকে ফাঁসাতে গিয়ে নিজেই র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। মূলত ইউসুফ তার প্রথম স্ত্রী নাসরিন আক্তারের নামে লিখিত সম্পদ আত্মসাতের লোভে হোসেনের মাধ্যমে ২টি অস্ত্র ও দুই হাজারের বেশি মাদক দিয়ে তাকে ফাঁসাতে চেয়েছিলেন। এসব অস্ত্র ও মাদক সরবরাহ করেছেন হোসেন। হোসেনের বিরুদ্ধে মাদক ও অস্ত্র আইনে দুটি মামলা দায়ের হয়েছে।

আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!