চাঁদা চেয়ে ‘অস্ত্র ঠেকিয়ে খুনের হুলিয়া’—মামলা খেলেন ওসিসহ ৪ পুলিশ

‘তুই জান্নাতে যাবি, তোকে জান্নাতের মেহমান হিসেবে পাঠানোর জন্য এখানে এনেছি।’

এমন হুমকি বন্দর থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহিউদ্দিন মাহামুদের। চোখে কালো কাপড় বেঁধে কর্ণফুলী নদীর পাড়ে নিয়ে মো. কামরুল ইসলাম (৪৮) নামের এক ব্যক্তির কপালে অস্ত্র ঠেকিয়ে এ হুমকি দিয়েছিলেন তিনি।

 এ ঘটনায় ৪ পুলিশ সদস্যসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করেন পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া থানার কাকড়া ইউনিয়নের আবদুল হক খলিফার ছেলে মো. কামরুল ইসলাম (৪৮)। বুধবার (১৯ অক্টোবর) চিফ মেট্রোপলিটন আদালতে মামলাটি করেন ভুক্তভোগী কামরুল ইসলাম। যিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারল হাসপাতালে ওয়ার্ড মাস্টার হিসেবে কর্মরত।

মামলার আসামিরা হলেন- বন্দর থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বর্তমানে সিটিএসবিতে কর্মরত (ওসি) মহিউদ্দিন মাহামুদ (৫৫), বর্তমানে আকবর শাহ থানায় এসআই হিসেবে কর্মরত মো. রবিউল ইসলাম৷ (৫০),৷ সিলেটে এবিপিএনে কর্মরত কেএম জান্নাত সজল (৩৫), সিলেটে কর্মরত পুলিশ সদস্য মঙ্গল বিকাশ চাকমা (৪৭), পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া থানার সবুজ নগর ইউনিয়নের মো. চাঁন মিয়া ফরাজীর দুছেলে মো. জামাল ফরাজী৷ (৪৭) ও মিলন ফরাজী।

মামলা সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ মধ্যম হালিশহরের মো. জামাল ফরাজীর দিশা ফাউন্ডেশন নামের সমিতিতে মাসিক ভিত্তিতে ২০১১ সালের ১৩ জুলাই থেকে কামরুল ইসলামসহ আরো কয়েকজন মিলে নিয়মিত টাকা জমা রাখেন। ২০১৬ সালের জুনে তারা দিশা ফাউন্ডেশেনের কার্যালয়ে গিয়ে দেখে প্রতিষ্ঠানটি উধাও হয়ে  গেছে। পরে সমিতির সদস্যরা মিলে প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. জামাল ফরাজীর কাছে গেলে তিনি এক বছরের মধ্যে ২৮টি জমা বইয়ের সদস্যেদের মোট ২ লাখ ৯১ হাজার ৯০৬ টাকা ফেরত দেবে বলে লিখিত দেন।

আরও পগুন: চট্টগ্রাম নগর পুলিশের দুই এসআইয়ের বিরুদ্ধে বিচারকের মামলা, পরোয়ানা

এদিকে  ২০১৮ সালের ৮ জুন টাকা চাইতে দক্ষিণ মধ্য হালিশহর ইছহাক ডিপোর সামনে গেলে জামাল ফরাজী, মিলন মাঝি, মো. বাদশা, আবদুর রহিম, আওলাদসহ আরো ৪-৫ জন মিলে কামরুল ইসলামের ওপর হামলা করেন। এসময় তাকে মারধর করে হাতে থাকা সমিতির আরো তিনটি জমা বই কেড়ে নেন। এসময় ঘটনাস্থলে বন্দর থানার সাবেক পুলিশ সদস্য এসআই মো. রবিউল ইসলাম পেট্রোল ডিউটিতে থাকলেও রহস্যজনকভাবে তাদের কোনো সহযোগিতা করেননি।

পরে ১১ জুন কামরুল ইসলাম হাসাপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বন্দর থানায় মামলা করতে গেলে এসআই রবিউল ইসলাম মামলা না নিয়ে উল্টো গালিগালাজ করে থানা থেকে বের করে দেন। এসময় তাকে এ ঘটনায় কোনো বাড়াবাড়ি করেতেও নিষেধ করেন এসআই রবিউল ইসলাম। পরে তিনি একটি সিআর মামলা করেন। যা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ১-এ বিচারাধীন।

এদিকে ২০১৮ সালে ১৩ ডিসেম্বর কামরুল ইসলাম মামলার ওয়ারেন্ডভুক্ত আসামিদের ধরার অনুরোধ করতে বন্দর থানায় গেলে তৎকালীন ওসি মহিউদ্দিন মাহামুদ তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। এসমন তিনি বাদীকে ২৪ ঘণ্টর মধ্যে মামলা তুলে নিতে হুমকি দেন।মামলা তুলে না নিলে পরিণাম ভয়াবহ হবে বলে তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে থানা থেকে বের করে দেন।

মামলা প্রত্যাহার না করায় ১৩ ডিসেম্বর কামরুল ইসলামকে বন্দর থানায় মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেন।অন্যদিকে ২০১৯ সালে ১০ জানুয়ারি কামরুল ইসলামকে তৎকালীন বন্দর থানায় কর্মরত এসআই কেএম জান্নাত একটি সাদা মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে যান। এরপর তাকে হাতকড়া পরিয়ে মুখে কালো কাপড় বেঁধে  বিভিন্ন স্থানে ঘুরাতে থাকেন। সেদিন আনুমানিক রাত ১২টার দিকে তাকে কর্ণফুলি নদীর পাড়ে নিয়ে চোখ খুলে দিলে সেখানে ওসি মহিউদ্দিন মাহামুদ ও জামাল ফরাজীকে দেখতে পান কামরুল ইসলাম।

এসময় ওসি মহিউদ্দিন মাহামুদ তাঁর কপালে অস্ত্র ঠেকিয়ে ১ লাখ টাকা চাঁদা দাবি ও জামাল ফরাজীর কাছে কোনো টাকা পাবে না বলে লিখিত দেওয়ার হুমকি দেন। না দিলে তাঁকে গুলি করে জান্নাতের মেহমান বানিয়ে দেবে বলে হুমকি দেন। এসময় হঠাৎ ওসি মহিউদ্দিন মাহমুদের মোবাইলে কল এলে তিনি ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান।

তাঁকে গুলি করে মারতে না পেরে আক্ষেপের সুরে ওসি মহিউদ্দিন মাহামুদ বলেন, শালাকে মারা যাবে না, গাড়িতে তোল, গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে আস।

পরে তাকে থানায় নিয়ে অসা হয়। সেই মামলায় ৪ দিন পর জামিনে বেরিয়ে আসেন কামরুল ইসলাম।

এদিকে কামরুল ইসলাম ১৭ জানুয়ারি  মামলার বিষয়ে কথা বলতে থানায় গেলে ওসি মহিউদ্দিন মাহমুদ বলেন, শালা তুই জামিন পাইলি কেমনে, আমিতো তোকে সারা বাংলাদেশের থানায় থানায় মামলায় জড়াব। এই বলে তাকে থানা থেকে বের করে দেন।

এদিকে মামলায় কামরুল ইসলামের কোনো সংশ্লিষ্টতা না পেয়ে তাকে রেহাই দিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদন দিলে তারা নারাজি দেয়। পরে মামলাটি গোয়েন্দা শাখায় হস্তাস্তর করা হয়।

 পুনর্তদন্তেও তার কোনো সংশ্লিষ্টতা না পেয়ে প্রতিবেদন দিলে তা আদালত গ্রহণ করেন। এতেও না পেরে পরে তাকে বন্দর থানার একটি মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালান।

আরও পড়ুন : ‘পুলিশের চাঁদাবাজি’ তরুণ—তরুণীকে হোটেলে বেঁধে টাকা নেন এসআই হেলাল

এ ঘটনায় ২০১৯ সালের ১৬ এপ্রিল পুলিশ সদস্য মঙ্গল বিকাশ চাকমা ও ‍দুভাই জামাল ফরাজী ও মিলন ফরাজীকে তলব করেন তৎকালীন পুলিশ কমিশনার। পরে মঙ্গল বিকাশ চাকমাকে সিলেট বিভাগে বদলি করা হয়।

এসব ঘটনায় হয়রানিমূলক মামলা থেকে রেহাই পেতে কামরুল ইসলাম বন্দর থানার সাবেক ওসি মহিউদ্দিন মাহামুদসহ ৪ পুলিশ সদস্যসহ ৬ জনের বিরুদ্ধ চিফ জুডিময়িাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করেন।

সিএম/আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!