চট্টগ্রামের সংস্কৃতি, উৎসব আর সঙ্গীত জগতকে আমৃত্যু ঋদ্ধ করে গেছেন সৈয়দ মহিউদ্দিন। সাধনা, উৎকর্ষতা আর চিন্তার গভীরতায় সুর-শব্দকে দিয়ে গেছেন অনন্য জাদুকরি ভাষা। যে জাদুর শক্তিশালী সিঁড়ি বেয়ে নতুন এক উচ্চতা পেয়েছিল চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান। আমাদের হৃদয়ে সেই জাদুর রেশ রয়ে গেছে আজও। কিন্তু সেই আঞ্চলিক গানের জাদুকর সৈয়দ মহিউদ্দিন পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন গত বছরের এদিনে। আজ (৭ এপ্রিল) তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী।
এদিকে প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রয়াতের গ্রামের বাড়ি ফটিকছড়ির সুয়াবিলে পারিবারিকভাবে নানা আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া আগামী ১১ এপ্রিল নগরের চেরাগী পাহাড়ে স্মরণসভা ও সাংস্কৃতিক আয়োজন রেখেছে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘খিড়কি’।
সৈয়দ আমির হোসেন ও সৈয়দা আনোয়ারা বেগমের সন্তান সৈয়দ মহিউদ্দিন। তিনি ছিলেন সংসার বিরাগী মানুষ। অথচ তার সৃষ্টি জগৎসংসারের প্রতিচ্ছবি হয়েছিল। তাঁর লেখায় চট্টগ্রামের মানুষ, প্রকৃতি, সংস্কৃতি, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন উঠে এসেছিল অনন্য ঢঙে। কখনো বস্তু কিংবা ভাব, কখনো সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, ব্যক্তি; সবখানেই বিচরণ ছিল চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের এই গীতিকারের।
‘অ জেডা ফইরার বাপ’, ‘মেজ্জান দিয়ি মেজ্জান দিয়ি’, ‘গর্কি তুয়ান-বইন্যা-খরা মোহামারি ঘুন্নিঝড়’, ‘হেডমাস্টার’, ‘পিরিত মানে ফুডুর ফাডুর’, ‘সাম্পান মাঝি সাম্পান বায় আগর মতো পেসিঞ্জার ন পায়’, ‘আঁর বউয়রে আঁই হাসাইয়ম আঁই কাঁদাইয়ম’, ‘আঁর বাপর বাড়ি কধুরখীল হউরু বাড়ি গুজারা’, ‘আসকার ডিঁইর পুবপাড়ে আঁর ভাঙাচোরা ঘর’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় আধুনিক ও মাইজভাণ্ডারি গানের স্রষ্টা এই সৈয়দ মহিউদ্দিন।
আশির দশকে যখন আধুনিক গানের ডামাডোল ও আঞ্চলিক ভাষার বিকৃতিতে চাঁটগাইয়া গানের অবক্ষয় দেখা দেয় ঠিক তখন সৈয়দ মহিউদ্দিনই তার নিখাদ সৃষ্টি দিয়ে সেই অবক্ষয় থেকে আঞ্চলিক গানকে নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে যান।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি শেফালী ঘোষ ও শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের সঙ্গীতগুরু ছিলেন সৈয়দ মহিউদ্দিন। তার কথা ও সুরে শেফালী-শ্যামের বহু গান আজও দাগ কাটে শ্রোতাদের হৃদয়ে। এছাড়া তার অনেক জনপ্রিয় গানে কণ্ঠ দিয়েছেন আবদুর রহিম, সনজিত আচার্য্য, কল্যাণী ঘোষ, কল্পনা লালা, রবি চৌধুরী, আলাউদ্দিন তাহের, শিমুল শীল, প্রেমসুন্দর বৈষ্ণব, জলি দাশ ও ফকির শাহাবুদ্দিনের মতো গুণী শিল্পীরা।
এমন গুণী গীতিকার দীর্ঘ বছরের অসুখে ভোগার পাশাপাশি সীমাহীন কষ্ট-দুর্ভোগ এবং রাষ্ট্রীয় অবহেলার শিকার হয়ে ৭৭ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে যান। এর আগ পর্যন্ত তাঁর দেখভাল ও চিকিৎসায় শুভানুধ্যায়ী, ভক্ত ও শিষ্যরা এগিয়ে আসেন।
২০১৫ সালের ৪ ডিসেম্বর ডিসি হিলে দেওয়া এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন সৈয়দ মহিউদ্দিন। কিন্তু ক্রেস্ট ও সনদ নিয়ে মঞ্চ ছাড়ার সময় পা পিছলে পড়ে যান। এতে তার বাম হাত ও বাম পা ভেঙে যায়। এরপর থেকে শয্যাশায়ী হয়ে মানবেতরর জীবনযাপন করতে থাকেন তিনি।
চট্টগ্রামের সঙ্গীতাঙ্গনে গীতিকার সৈয়দ মহিউদ্দিনের মতো নক্ষত্রের হারিয়ে যাওয়ার গল্পটা মলিন। কিন্তু সঙ্গীতপ্রেমী ও ভক্ত-শিষ্যদের হৃদয়ে তিনি এখনও শক্তিমান এক গানের জাদুকর। নিজের সৃষ্টিতে অমর সৈয়দ মহিউদ্দিন।
আরবি/আলোকিত চট্টগ্রাম