ইজারাদারের দাপট—১২ জনের নৌকায় ৫০ জন, মরণফাঁদে সল্টগোলা ঘাটের যাত্রীরা

কর্ণফুলীর উপজেলার জুলধা ইউনিয়নের ডাঙ্গারচর-সল্টগোলা নৌঘাট যেন মরণফাঁদ। এখানে যাত্রী পরিবহণে অনিয়ম এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন দ্বিগুণ-তিনগুণ যাত্রী নিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলছে ঘাটের নৌযানগুলো। নিধারিত ভাড়া ১০ টাকা হলেও যাত্রীদের গুণতে হয় এর দ্বিগুণ। ইজারাদারের দাপটে এখানে অসহায় যাত্রীরা।

জানা যায়, ইজারাদার ও সাব-ইজারাদারের গাফিলতির কারণে বারবার ঘাট পারাপারে দুর্ঘটনা ঘটলেও দেখার যেন কেউ নেই। গত ১২ বছরে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনায় ১০-১২ জনের মর্মান্তিক প্রাণহানি ঘটেছে। তবুও টনক নড়েনি সংশ্লিষ্টদের।

আরও পড়ুন: পাহাড়ে পাহাড়ে বাণিজ্য, মরণফাঁদের ‘টার্গেট’ আলম-আমিনরাই

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২১ মার্চ ডাঙ্গারচর-সল্টগোলা যাত্রী পারাপার পাটনী শ্রমজীবি সমবায় সমিতি ও ইজারাদারের বিরুদ্ধে যাত্রী হয়রানিসহ নানা অভিযোগে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র, জেলা প্রশাসক, উপজেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন দপ্তরে স্মারকলিপি দেন স্থানীয়রা। এরপরও অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি।

স্থানীয়রা জানান, ডাঙ্গারচর-সল্টগোলা ঘাট হয়ে চরলক্ষ্যা, ডাঙ্গারচরের অন্তত ৮ হাজার মানুষ নিয়মিত যাওয়া-আসা করেন। স্কুল-কলেজ, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরিসহ অন্যান্য প্রয়োজনে দুই গ্রামসহ আশপাশের অন্তত ১৫ হাজার লোকের ভরসা ডাঙ্গারচর-সল্টগোলা ঘাট।

এছাড়া প্রতিদিন নৌকাযোগে ডাঙ্গারচর রহমানিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ডাঙ্গারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও হালিশহর বেগম জান উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা পারাপার হয়। শিল্প কারখানার অনেক শ্রমিক নদী পাড় হয়ে এই এলাকার ভাড়া ঘরে বসবাস করছেন।

স্থানীয়রা আরও জানান, ব্যস্ততম এই ঘাটে মাত্র দুটি নৌকাই ভরসা। একটি নৌকার ধারণক্ষমতা ১২ জন হলেও প্রায়ই নেওয়া হয় ৫০ জনের বেশি। আবার দুপুর বেলা বন্ধ রাখা হয় একটি নৌকা। এ অবস্থায় মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে নিয়মিত আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে এলাকার মানুষকে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ইঞ্জিনচালিত নৌকাগুলো চালানো হচ্ছে অদক্ষ চালক দিয়ে। ঘাট দিয়ে শিশু, নারীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নদী পার হচ্ছেন। নদীর পাড়েও যাত্রী ওঠানামায় রয়েছে নানা সমস্যা। ঘাটে মানুষের তুলনায় নৌকা কম থাকায় দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে যাত্রীদের। বাড়তি ভাড়ার পাশাপাশি গাদাগাদি করে উঠানো হচ্ছে যাত্রীদের।

স্থানীয় বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম হৃদয় বলেন, ডাঙ্গারচর-সল্টগোলা ঘাট চলছে আল্লাহর ওয়াস্তে। ২০১৭ সালে যাত্রীদের হয়রানি ও অতিরিক্ত যাত্রী বহনের প্রতিবাদে সভাসহ নানা কর্মসূচি পালন করে এলাকাবাসী। ১২ জনের নৌকায় ৫০/৬০ জন যাত্রী নেওয়া হয়। যাত্রীর ভিড়ের মধ্যে তোলা হয় মালামাল। নৌকার পাশে বন্দরের বড় জাহাজ আসা-যাওয়ার সময় মনে হয় এই বুঝি নৌকা ডুবে গেল।

আরও পড়ুন: ব্রিজ নয় যেন ‘মরণফাঁদ’—৫ বছরেও হয়নি সংস্কারমরণফাঁদে

তিনি আরও বলেন, ২০০৯ ও ২০১২ সালে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের ফলে নৌ দূর্ঘটনায় ১০-১২ জন স্থানীয় বাসিন্দা প্রাণ হারান। মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন আমাদের আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে। কিন্তু এসব সমস্যা দেখার কেউ নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাসিন্দা জানান, ইজারাদারের কাছে যাত্রীরা জিম্মি। এসব অনিয়মের কেউ প্রতিবাদ করলেও করা হয় মারধর। চসিক এ ঘাট থেকে প্রতিবছর লাখ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করলেও কোনোরকম তদারকি নেই। ফলে দিন দিন বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি।

জানা গেছে, আগের ইজারাদার মো. ওসমান চসিকের কালো তালিকাভুক্ত হলেও ঘাটটি সুকৌশল ইজারা নেন একই সংগঠনের মো. ইসহাক।

এ বিষয়ে জানতে ইজাদার মো. ইসহাক মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, আমি ইজারাদার না। ডিসির সঙ্গে কথা বলার সময় নাই, সাংবাদিকের সাথে কি কথা বলব— বলেই তিনি ফোন কেটে দেন। পরে আবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহিনা সুলতানা আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, ঘাটের ইজারাদারের অনিয়মের বিরুদ্ধে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন। তবে ঘাটটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অধীন। বিষয়টি আমি জেলা প্রশাসক মহোদয়কে জানাব।

তিনি আরও বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে কর্ণফুলীর প্রতিটি ঘাটে ভাড়া ও যাত্রী নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করে ইজারাদারদের জরিমানাও করা হয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে চসিকের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সৈয়দ শামসুল তাবরীজ আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, এ বিষয়ে লিখিত কোনো অভিযোগ পাইনি। তবে ইজারাদারের অনিয়মের বিষয়টি জেনেছি। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরবি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!