দুর্গাপূজা—শঙ্কায় চট্টগ্রামের হিন্দু নেতারা, জামিনে বেরিয়ে গেছে ‘সেই চেনামুখগুলো’

জগজ্জননী দেবী দুর্গার আগমনীর আনন্দে খুশির জোয়ারে ভাসছে হিন্দু সম্প্রদায়। বৃহৎ এই উৎসবকে ঘিরে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে সাজ সাজ রব। চলছে বর্ণিল আয়োজনের প্রস্তুতি। মণ্ডপে মণ্ডপে দিন-রাত চলছে সাজসজ্জা। শেষ মুহূর্তে মা’কে রাঙিয়ে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন মৃৎশিল্পীরা। তবে পূজার এমন আনন্দের মাঝেও রয়েছে শঙ্কা-ভীতি!

অথচ বাঙালির দুর্গোৎসবকে বিশ্বের সর্বোচ্চ সংস্থা ইউনেস্কো তাদের অধরা সংস্কৃতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে স্বীকৃতি দিয়েছে। এখন বাঙালির এই দুর্গোৎসব রূপ নিয়েছে আন্তর্জাতিক উৎসবে। কিন্তু শঙ্কা-ভীতির কারণে বিশেষ এই স্বীকৃতি পরও যেন উৎসবে পরিপূর্ণতা আসছে না।

গতবছর চট্টগ্রামের জেএম সেন হলে হামলাকারীরা সবাই জামিনে থাকায় এবারের দুর্গাপূজায় শঙ্কার কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ ও চট্টগ্রাম মহানগর নেতারা। সেই সঙ্গে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির ও ঘরবাড়ি সংস্কার এবং আইনি ব্যবস্থা নেওয়াসহ সরকারের কাছে ১৪ দফা দাবি তুলে ধরা হয়।

মঙ্গলবার (২৭ সেপ্টেম্বর) সকাল ১১টায় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের এস রহমান হলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে এসব দাবি তুলে ধরেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হিল্লোল সেন উজ্জ্বল।

এসময় তিনি বলেন, বিগত দিনে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম যাতে সাম্প্রদায়িক ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে এবং এর আশু ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য। তারপরও আমরা লক্ষ্য করছি, দেশের কিছু কিছু স্থানে মৌলবাদী-ধর্মান্ধ গোষ্ঠী সনাতনী সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও নির্যাতন চালিয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন স্থানে জবরদখল, মন্দিরে হামলা, প্রতিমা ভাঙচুরের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা এখনও ঘটে চলেছে।

হিল্লোল সেন উজ্জ্বল বলেন, গতবছর ১৫ অক্টোবর বিজয়া দশমীর দিন চট্টগ্রামের প্রধান পূজামণ্ডপ জে এম সেন হলে হঠাৎ হামলা হয়। এসময় বিভিন্ন সামাজিক, ধর্মীয় সংগঠন প্রতিবাদ জানালে প্রশাসনের সহযোগিতায় ৮ ঘণ্টার মধ্যে সিসিটিভি ভিডিও ফুটেজ দেখে প্রায় ৭৬ জনকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হয়। আসামিরা দীর্ঘদিন জেলহাজতে থাকার পর উচ্চ আদালত থেকে একে একে জামিনে বের হয়ে আসায় আমরা শঙ্কিত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিথ্যা পোস্ট দিয়ে সম্প্রীতি নষ্ট করার অপচেষ্টা থেকে বিরত ও সজাগ থাকতে হবে। আমরা প্রত্যাশা রাখি বর্তমান সরকারের সার্বিক সহযোগিতা ও বলিষ্ঠ ভূমিকায় এবারের শারদোৎসব সুষ্ঠু ও শান্তি-শৃঙ্খলার মাধ্যমে সম্পন্ন হবে।

তিনি বলেন, প্রতিবছরের মতো এবারও মহানগরের জেএমসেন হলসহ ১৬টি থানায় ব্যক্তিগত/ঘট পূজাসহ প্রায় ২৮৩টি পূজা মণ্ডপে ১ অক্টোবর থেকে ৫ অক্টোবর ৫ দিনব্যাপী দুর্গোৎসব উদযাপিত হবে। গত ২৫ অক্টোবর রোববার জেএম সেন হলে দেবীপক্ষের সূচনা শুভ মহালয়া অনুষ্ঠিত হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, নগরের সব পূজামণ্ডপ ডিজেমুক্ত ও প্রতিটি মণ্ডপ সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া পূজার আনুষ্ঠানিকতা রাত ১২টার মধ্যে শেষ করার জন্য পূজার আয়োজকদের প্রতি অনুরোধ করা হয়েছে। প্রতিমা বিসর্জন ৫ অক্টোবর বুধবার দুপুর ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরা ১৪ দফা দাবি হলো— ৭২’র সংবিধানের আলোকে সকল সম্প্রদায়ের সমঅধিকার নিশ্চিত করা, মঠ-মন্দির, ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, হত্যা, লুটপাট, হামলা-ভাঙচুরসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে শাস্তির ব্যবস্থা করা, শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে ৪ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা, শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি আইন কার্যকর করে প্রকৃত ভূমি মালিকদের ফেরত দেওয়া, সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড, পুলিশ প্রশাসন ও সচিবালয়সহ সকল সরকারি-আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে সংখ্যালঘু প্রতিনিধিদের আনুপাতিক হারে নিয়োগ, সরকারি সংস্কৃত কলেজ স্থাপনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন, বাংলাদেশ হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্টকে ফাউন্ডেশনে উন্নীত করা, সীতাকুণ্ডকে জাতীয় তীর্থস্থান ও ঢাকেশ্বরী মন্দিরকে জাতীয় মন্দির হিসেবে রাষ্ট্রীয় ঘোষণা, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে রাজনীতি ও নির্বাচনে ধর্ম এবং সাম্প্রদায়িকতার ব্যবহার নিষিদ্ধ করা, চন্দ্রনাথ ধাম ও কক্সবাজার ‘আদিনাথ মন্দিরে সরকারি সহায়তায় উন্নয়নের ব্যবস্থা এবং দেবোত্তর সম্পত্তি সংরক্ষণ আইন দ্রুত প্রণয়ন করা, দক্ষিণ কাট্টলীর বারুণী স্নানের জন্য রানী রাসমনি ঘাটের ৫ একর জায়গা বরাদ্দ দেওয়া, শারদীয় দুর্গোৎসব চলাকালীন সরকারি-বেসরকারি সকল স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখা, সারা দেশে জেলা ও মহানগর পর্যায়ে একটি করে মডেল মন্দির নির্মাণে ভূমি বরাদ্দ দেওয়া।

এর আগে গত বছরের ১৩ অক্টোবর দুর্গাপূজার মহাঅষ্টমীর দিন বুধবার ভোরে কুমিল্লা শহরের নানুয়াদীঘির একটি পূজামণ্ডপে কোরআন শরিফ পাওয়া যায়। পরে একদল লোক কোরআন শরিফ অবমাননার অভিযোগ তুলে ওই পূজামণ্ডপে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। ঘটনার এক সপ্তাহ পর সিসিটিভি ফুটেজ চেক করে কুমিল্লা সুজানগর এলাকার নূর আহমেদ আলমের ছেলে ইকবাল হোসেনকে (৩৫) শনাক্ত করে পুলিশ। পরে তাকে মানসিক রোগী বলেও আখ্যা দেওয়া হয়।

এ ঘটনার দুদিন পর ১৫ অক্টোবর শুক্রবার জুমার নামাজের পর একটি মিছিল থেকে নগরের প্রধান পূজামণ্ডপ জেএম সেন হলের গেটে সংঘবদ্ধ হামলা করা হয়।

আরও পড়ুন: জেলেদের আতঙ্ক ‘গাভী ইলিয়াছ’ ধরা খেল পতেঙ্গায়

আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে জুমার নামাজ শেষে ৫০০ থেকে ৭০০ লোক ‘কুমিল্লার ঘটনার প্রতিবাদ’ জানিয়ে সমাবেশ করে। বেলা ১টা ৪০ মিনিটে নিউমার্কেট এলাকার আমতল, গোলাম রসুল মার্কেট ও রিয়াজউদ্দিন বাজার এলাকা থেকে আরও হাজারখানেক লোকের একটি মিছিল তুলসীধামের মন্দির এবং নন্দনকানন লোকনাথ মন্দির হয়ে আন্দরকিল্লায় আসার চেষ্টা করে। এ সময় মিছিলটি কোতোয়ালী জোনের সহকারী কমিশনার ও ওসির নেতৃত্বে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে নন্দনকানন বোস ব্রাদার্স মোড়ে। এরপর মিছিলটি সিনেমা প্যালেস হয়ে আন্দরকিল্লা মোড়ে এসে বিক্ষোভে মিলিত হয়।

সেখান থেকে তারা মিছিল নিয়ে জেএমসেন হলের দিকে এগিয়ে যায়। শুরুতেই তারা আন্দরকিল্লা মোড়ে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এর মধ্যে কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে মিছিলটি। একটি গ্রুপ সিরাজদ্দৌল্লা সড়কে, একটি গ্রুপ রেডক্রিসেন্ট গলিতে এবং অপর গ্রুপটি মসজিদে ঢুকে পড়ে। তবে এই ফাঁকে প্রায় একশ লোক চলে যায় চেরাগি পাহাড় মোড়ের দিকে। এই গ্রুপটি মূলত জেএমসেন হলের তোরণের ব্যানার ও কাপড় ছিঁড়ে ফেলে এবং মন্দিরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। যদিও পরে টিয়ারশেল ছুঁড়ে হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ।

এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কোতোয়ালী থানার সাবেক অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নেজাম উদ্দিন ফাঁকা গুলি ছুঁড়েন। ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৮৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়। এতে আসামি করা হয় অজ্ঞাত আরও পাঁচ শতাধিক মানুষকে। তবে গ্রেপ্তারদের প্রায় সবাই এখন জামিনে বেরিয়ে এসেছেন।

আরএস/আরবি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!