‘জলমগ্ন চট্টগ্রাম’ মেয়র রেজাউল—সিডিএ চেয়ারম্যান মুখোমুখি

বৃষ্টিতে ডুবেছে নগর। পানিবন্দী নগরবাসীর দুর্ভোগেরও শেষ নেই। এ অবস্থায় মুখোমুখি অবস্থানে দুই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের প্রধান। একদিকে সিটি মেয়র রেজাউল করিম, অন্যদিকে সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ। ইতোমধ্যে সংবাদ সম্মেলন করে একে অন্যের ওপর দায়ও চাপিয়েছে। নগরের জলাবদ্ধতা দূর করার দায়িত্বে থাকা দুই প্রতিষ্ঠানের এমন মুখোমুখি অবস্থান আরও শঙ্কা বাড়াচ্ছে পানিবন্দী নগরবাসীর।

এদিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে (চসিক) অযোগ্য বলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (সিডিএ) কাজ দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ।

তিনি বলেন, সিডিএ জলাবদ্ধতার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বলে সবাই মনে করেছে সব দায় সিডিএ’র। মূলত সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতার কাজ করতে না পারায় সিডিএকে প্রকল্প দেওয়া হয়। সিডিএ শুধু একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। মেয়র সাহেব ভুল তথ্য দিয়ে সিডিএকে দোষারোপ করছেন।

আরও পড়ুন : চট্টগ্রামজুড়ে ভয়াবহ জলজট, চউকের ঘাড়েই দায় চাপাচ্ছে চসিক

বুধবার (৯ আগস্ট) দুপুরে সিডিএ সম্মেলনে কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি মেয়রের দেওয়া বক্তব্যকে মিথ্যা বলেও দাবি করেন।

অন্যদিকে সিডিএ চেয়ারম্যানের কথার পাল্টা জবাবে সাংবাদিকদের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, আমি কাউকে দোষারোপ করব না। চসিক-সিডিএ দ্বন্দ্ব নয়। চট্টগ্রাম শহরবাসী যাতে স্বস্তি পায় সেজন্য কথাগুলো বলতে হচ্ছে। কারও প্রতি বিদ্বেষ নেই। খালগুলো দেখে আসেন। আত্মপক্ষ সমর্থনের কিছু নেই। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ চসিকের হাতে নেই।

মেয়র বলেন, সিডিএর চিফ ইঞ্জিনিয়ার একজন কর্মচারী। তিনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত প্রতিনিধি কাউন্সিলরদের প্রতি আঙুল উঁচু করে কথা বলতে পারেন না এবং করপোরেশনকেও দোষারোপ করতে পারেন না। উনি কোন জরিপের ওপর ভিত্তি করে বলছেন, নালাগুলো ভরাট তাই জলাবদ্ধতা হচ্ছে। তিনি কী জরিপ চালিয়েছেন?

মেয়র বলেন, ডিপিপিতে দেখছি সাড়ে ৯ লাখ ঘনমিটার মাটি উত্তোলন ও ভূমি অধিগ্রহণের কথা। এরপরও পাহাড় পরিমাণ মাটি কেমনে চাক্তাই খালে থাকে? প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে চট্টগ্রামবাসী সুফল পাবে। এ প্রকল্প সিটি করপোরেশনের কাছে থাকলে দায়দায়িত্ব আমার ওপর পড়ত। ঢাকায় আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বলেছি, খালের দুপাশে দেয়াল দেওয়ার আগে মাটি উত্তোলন করেন। নয়ত গতবার একগলা পানি হয়েছে এবার পানি গলার ওপর হবে।

তিনি বলেন, খালের মুখ ৯০ ফুট, স্লুইস গেট সরু। প্রবল স্রোতে যাওয়া পানি সরতে পারে না। সেখানে ময়লা আটকে থাকে। স্লুইসগেটে জলকপাট লাগানো হয়নি। প্রবল জোয়ারের কারণে পানি বেশি হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ২১টি খালের দায়িত্ব শুধু চসিকের নয়। এগুলো উপখাল। আরএসে আছে, সিএসে আছে। কিন্তু খালের কোনো অস্তিত্ব নেই। প্রভাবশালীরা সব ভরাট করে ফেলেছে। মন্ত্রণালয়ে ফান্ড দেওয়ার জন্য বলেছি। কারণ চসিকের এত অর্থ নেই সেসব খাল পুনঃখনন করার।

জানা যায়,  ২০১৭ সালের আগস্ট ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে সিডিএকে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের অনুমোদন দেয় সরকার। এরপর ২০২২ সালে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ৯ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা করা হয়। সর্বশেষ আরও চার হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয় এ প্রকল্পে।

২০১৭ সাল থেকে প্রকল্পের কাজ চলমান ও বাজেট বাড়ানো পররও মিলছে না কাজের সুফল। সামান্য বৃষ্টি হলেই ডুবে যাচ্ছে নিচু এলাকা।

সিডিএর দুটি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি প্রকল্পের আওতায় ১১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকার কাজ চলমান থাকলেও প্রতিবছর বৃষ্টিতে ডুবছে চট্টগ্রাম শহর।

এদিকে চলতি মাসে টানা চারদিনের বৃষ্টিতে ডুবে একাকার ছিল বন্দর নগরী। কোথাও হাঁটু, আবার কোথা কোমরপানি। এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি যখন চরমে ঠিক তখন সিটি মেয়র ও সিডিএ চেয়ারম্যান একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপাতে ছিলেন ব্যস্ত।

এসব নিয়ে চসিক-চউকের সমন্বয়হীনতার অভাবকে দুষছেন নগরবাসী। দুই সংস্থাকে দায়ী করে ফেসবুকে উঠে সমালোচনার ঝড়।

ইশতিয়াক চৌধুরী নামে একজন লিখেন, ২০১৭ সাল থেকে প্রকল্প চলছে। প্রতিবছর ডুবে যায়। আর প্রতিবছর নগর ডুবে গেলে দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই প্রতিষ্ঠানের মিটিং দেখা যাবে৷ কী করলে জলাবদ্ধতা কমবে সেটি শোনা যায়। কিন্তু কাজ আর বাস্তবায়ন হয় না৷

ইশফাক মাহমুদ নামে আরেকজন ক্ষোভ প্রকাশ করে লেখেন, প্রকল্প চলমান ২০১৭ সাল থেকে। তাও প্রতিবছর ডুবে যাচ্ছে নিচু এলাকা। সিডিএ দাবি করছে ৭৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে তাহলে কিভাবে গোটা চট্টগ্রাম পানির নিচে থাকে?

নগরের বহদ্দারহাট এলাকায় তাবিব নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, মেয়র নির্বাচনের সময় জলাবদ্ধতা নিরসন করবো এমন প্রতিশ্রুতি শোনা যায়। এখন মেয়রের বাসভবনও ডুবে যাচ্ছে। মেয়র বলেন, এটি আমার কাজ না, সিডিএ বলে আমার কাজ না। তাহলে কার কাজ? ফাঁকি কে দেয়? ভোগান্তিতে তো আমরা আছি।

এদিকে প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) প্রতিশ্রুতি থাকলেও কথা আর কাজে মিল নেই। নির্ধারিত বাজেট ও নির্ধারিত সময়ের ভেতর শেষ করতে পারেনি প্রকল্পের কাজ। বাজেট বাড়িয়েও শেষ হয়নি কাজ। ফলে জলাবদ্ধতার ভোগান্তি থেকে এখনই মুক্তি মিলছে না নগরবাসীর।

জানা যায়, সিডিএর প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে চলতি বছরের জুন মাসে। এখন আর কাজ করার মত অর্থ নেই প্রতিষ্ঠানটির কাছে৷ তবে ফের বাজেট বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সরকারকে।

ইতিমধ্যে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ ৭৬ দশমিক ২৫ শতাংশ শেষ হয়েছে বলে দাবি সিডিএর।

প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম নগরে প্রায় ৫৭টি খাল রয়েছে।সিডিএ এর প্রকল্পের আওতায় খাল রয়েছে ৩৬টি। সেনাবাহিনীর বাস্তবায়নাধীন ৩৬টি খালের মধ্যে ২৬টি খালের কাজ প্রায় শেষ। বাকি ১১টি খালের কাজ ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় আটকে আছে। বাকি ২১টি টারশিয়ারি খালের দায়িত্বে আছে চসিক।

আরবি/আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!