চট্টগ্রামজুড়ে ভয়াবহ জলজট, চউকের ঘাড়েই দায় চাপাচ্ছে চসিক

টানা দুদিন ধরে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার কবলে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। কোথাও হাঁটু, আবার কোথাও কোমরপানি। এতে জনজীবনে দেখা দিয়েছে চরম দুর্ভোগ।

এদিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরীর বাসভবনও দুদিন ধরে পানির নিচে রয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরের চান্দগাঁও, বাকলিয়া, মোহরা, বাদুরতলা, কাপাসগোলা, কাতালগঞ্জ, চকবাজার, বহদ্দারহাট, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, মিয়াখান নগর, খাজা রোড, বাস টার্মিনাল, প্রবর্তক মোড়, মুরাদপুর, মেহেদীবাগ, ষোলশহর, ২ নম্বর গেইট, হালিশহরসহ বিভিন্ন এলাকা পানিতে ডুবে আছে। এসব এলাকার রাস্তা-ঘাট, অলিগলি ও নিচতলার ঘরবাড়ি ও দোকানে পানি ঢুকে গেছে। এছাড়া পানিতে নষ্ট হয়েছে মূল্যবান মালামাল। এখনও নগরের এলাকার মানুষ পানিবন্দী।

এদিকে নগরের বেশিরভাগ রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কমে গেছে গণপরিবহন চলাচল। কমে গেছে ব্যক্তিগত গাড়ির চলাচলও। এখন যাতায়াতের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে রিকশা। ফলে বেড়ে গেছে রিকশা ভাড়াও। জরুরি কাজে বাড়তি ভাড়ায় ছুটতে হচ্ছে গন্তব্যে।

আরও পড়ুন : চট্টগ্রামজুড়ে বৃষ্টি, ৩ নম্বর সতর্কসংকেত

বহদ্দারহাট এলাকায় কথা হয় মামুনুর রশীদ নামে এক পথচারীর সঙ্গে। তিনি আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, জরুরি কাজে নিউমার্কেট এলাকার উদ্দেশ্য বাসা থেকে বের হয়ে বহদ্দারহাট মোড়ে এসে আটকে গেছি। বহদ্দারহাট থেকে চকবাজার পর্যন্ত সড়ক পানিতে ডুবে যাওয়ায় এ রুটে গণপরিবহন চলছে না। রিকশা ভাড়া বলছে আড়াইশ টাকা।

এদিকে গত মে মাসে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প সম্পাদনকারী সংস্থা সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সট্রাকশন ব্রিগেডের কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ড্রেন থেকে নিয়মিত ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা না হলে বৃষ্টির পানি খালে যেতে বাধাপ্রাপ্ত হবে। এতে বিভিন্ন এলাকা পানিতে প্লাবিত হবে। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের সুফল নগরবাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক)। কারণ নিয়মিত নালা-নর্দমা পরিষ্কারের দায়িত্ব চসিকের।

এছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ বলেছিলেন, চসিক যদি খাল, নালা-নর্দমায় ময়লা আবর্জনা ফেলা বন্ধ করতে পারে তাহলে প্রকল্পের সুফল পাবে নগরবাসী।

অন্যদিকে চলতি বছরের শুরু থেকে জলাবদ্ধতার শঙ্কা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমেও প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এতে বর্ষা মৌসুমের আগে নিয়মিত নালা-নর্দমা পরিষ্কারের মাধ্যমে পানি চলাচল স্বাভাবিক করতে চসিকের কার্যকরী পদক্ষেপের কথা তুলে ধরা হয়েছিল। তবে এসবের তেমন কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি চসিকের বাজেটে।

চসিক সূত্রে জানা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত ১ হাজার ৮৮৭ কোটি ২৮ লাখ টাকার বাজেটে খাল, ছড়া, নালা-নর্দমা রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে জলাবদ্ধতা দূরীকরণে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ৩০ কোটি টাকা। এছাড়া চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই খাতে ২৪ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হলেও খরচ হয়েছে মাত্র ৭ কোটি টাকা।

এদিকে জলাবদ্ধতা নিরসনে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চউক। নগরে ৫৭টি খাল ও ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার নালা রয়েছে। এর মধ্যে প্রকল্পটির আওতায় ৩৬টি খাল ও ৩০০ কিলোমিটার নালা খনন ও সংস্কার করা হবে। নগরের বাকি ২১টি খাল ও ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার নালা নিয়মিত পরিষ্কার এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব চসিকের। চসিকের দায়িত্ব যথাযথ পালন নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন।

২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নগরবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। মেয়র নিজেই এখন পানিবন্দী।

এ বিষয়ে জানতে মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরীর মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

পরে মেয়রের একান্ত সচিব ও চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মু. আবুল হাশেমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, চসিকের অধীনে যে ২১টি খাল রক্ষণাবেক্ষণের কথা বলা হচ্ছে বর্তমানে এসব খাল দখল হয়ে আছে। তবে খাল দখলমুক্ত করতে ফিজিক্যাল স্টাডি করা হচ্ছে। ৫৭টি খালের মধ্যে যে ৩৬টি খাল প্রকল্পের আওতায় আছে কেবল সেগুলোর কাজ করছে চউক।

তিনি বলেন, টারশিয়ারি খালের দায়িত্ব হচ্ছে চসিকের। আর প্রাইমারি খালগুলোর দায়িত্ব চউকের। এখন যদি এমন হতো টারশিয়ারি খাল দিয়ে পানি প্রাইমারি খালে যাচ্ছে না তাহলে সিটি করপোরেশনের দায় থাকত। এখন তো প্রাইমারি খালগুলো পানিতে পরিপূর্ণ। এসব খালের গভীরতা নষ্ট হয়ে গেছে। খালগুলো থেকে ১৩ লাখ ঘনফুট মাটি তোলার কথা থাকলেও তোলা হয়েছে কেবল ২/৩ লাখ ঘনফুট। চউক যেসব স্লুইস গেট করেছে সেগুলো দিয়ে পানি যেতে পারছে না। গেইটগুলোর মুখ পলি জমে ভরাট হয়ে আছে। এছাড়া এগুলো এখনও আমাদের বুঝিয়ে দেয়নি চউক।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের আগস্টে পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক। এরপর ২০২২ সালে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ৯ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা করা হয়। নগরের ৫৭টি খালের মধ্যে ৩৬টির কাজ করা হয় এই প্রকল্পের অধীনে। বাকি ২১টি খালের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব চসিকের।

আরবি/আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!