চট্টগ্রামে ডেঙ্গু বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে, রোগীর চাপ বেশি ক্লিনিকে

চট্টগ্রামে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। প্রতিদিন নগরের পাশাপাশি উপজেলায় বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। শুরুতে জ্বর, পরে তীব্র জ্বরের সঙ্গে বমি, প্লাটিলেট কমে যাওয়া, শরীরে তীব্র ব্যথাসহ নানা উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন বিভিন্ন বয়সের রোগী। বর্তমানে অতিরিক্ত রোগীর চাপে হিমশিম অবস্থা সরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে। এছাড়া প্রতিদিন আউটডোরেও চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেক রোগী। পাশাপাশি চাপ বাড়ছে বেসরকারি ক্লিনিকেও।

এদিকে জ্বর হলে আতঙ্কিত না হয়ে ডেঙ্গু টেস্ট করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

চিকিৎসকরা বলছেন, যাদের জ্বর বেশি, বমির ভাব লাগে, খেতে পারে না রুচি নেই, প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে, শরীর দুর্বল তারাই মূলত হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। আক্রান্ত রোগীদের প্লাটিলেট সংখ্যা জানতে সিবিসি টেস্ট এবং তরল খাবার খেতে বলা হচ্ছে।

চিকিৎসকরা জানান, ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকিতে আছে বয়স্ক ও শিশুরা। আক্রান্ত অনেকের প্লাটিলেট আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায় এবং পেসার কমে গেলে আর উপরে তোলা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এছাড়া যাদের মাল্টিঅর্গান ডিসফাকশন আছে এবং যারা অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে তাদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) পর্যন্ত যেতে হচ্ছে।

সরেজমিন চমেক হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, মেডিসিন বিভাগের ১৩, ১৪ ও ১৬ নম্বর ওয়ার্ড ঠাসা ডেঙ্গু রোগীতে। সবচেয়ে বেশি রোগী ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে। এছাড়া ৮ ও ৯ নম্বর শিশু স্বাস্থ্য বিভাগে আছে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুরা৷ সেখানে সিট সংকুলান না হওয়ায় অনেকের চিকিৎসা চলছে মেঝেতে।

১৬ নম্বর ওয়ার্ডে কথা হয় চকবাজারের বাসিন্দা শিক্ষক মো. এমদাতের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার ছেলে মো. রিদওয়ান হোসেন সাগর জ্বর নিয়ে বাসায় ছিল প্রথম তিনদিন। বাসায় অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো হয়। এরপরও ১০৬ ডিগ্রি জ্বর চলে আসায় দ্রুত তাকে জরুরি বিভাগে নিয়ে আসি। বর্তমানে জ্বর কিছুটা কম। তবে জ্বরের সঙ্গে আছে টাইফয়েডও।

একই ওয়ার্ডে ডেঙ্গু আক্রান্ত স্ত্রীকে ভর্তি করানো নগরের আইস ফ্যক্টরি রোডের বাসিন্দা চাকরিজীবী শাহাবুদ্দিন বলেন, বৃহস্পতিবার রাত ১২টায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসি। এর আগে বাসায় ৪ দিন ধরে জ্বরে ভুগছিল। একপর্যায়ে জ্বরের সঙ্গে বাড়তে থাকে বমি। এখন টেস্ট করে দেখা গেছে প্লাটিলেট ৪৫ হাজারে নেমেছে।

বহদ্দারহাট এলাকার মো. সাকিব ডেঙ্গু আক্রান্ত ভাই মো.সাদকে (২২) নিয়ে ভর্তি করেন চমেক হাসপাতালের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে। তিনি বলেন, গত রোববার থেকে ভাইয়ের জ্বর। জ্বর বাড়তে থাকায় বৃহস্পতিবার ভোরে নিয়ে আসি হাসপাতালে৷ তখন বমির পাশাপাশি মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়ছিল। তবে আজ কিছুটা কম। যেহেতু প্লাটিলেট কমে গেছে তাই প্রতিদিন সিবিসি টেস্ট করতে বলা হয়েছে৷

বিজিবি সদস্য মো. মোস্তাফা কামাল ঢাকা হেডকোয়ার্টার থেকে ট্রেনিংয়ে এসেছিলেন সাতকানিয়ায়। সেখানে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বর্তমানে চমেক হাসপাতালের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন। গত ১৩ জুলাই ভর্তি হন তিনি। শুরুতে তীব্র জ্বর ছিল তাঁর। পরে প্লাটিলেট কমে ৫০ হাজারে নেমে আসে। তবে এখন আগের চেয়ে প্লাটিলেট কিছুটা বেড়েছে বলে জানান তিনি।

আরও পড়ুন: শেখ হাসিনার প্রার্থী মহিউদ্দিন বাচ্চুকে জয়ী করতে হবে : আ জ ম নাছির

এদিকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া অধিকাংশ রোগীর অভিযোগ ওয়াশরুম নিয়ে। রোগীর তুলনায় ওয়াশরুমের সংখ্যা কম এবং যথাযথ পরিচর্যা না করায় ওয়াশরুমগুলো ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এছাড়া ওয়ার্ডে দায়িত্বরত নার্সদের ডাকলেও আসেন না- এমন অভিযোগ রোগীর স্বজনদের। আবার অনেক রোগী মশারি না পাওয়ায় কিনে ব্যবহার করতে হচ্ছে।

এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, আমাদের মশারির সংকট নেই। এখনও ৮০০ মশারি স্টোরে জমা আছে। তবে ওয়াশরুম সমস্যা রয়েছে। আমাদের ক্লিনার কম।

তিনি বলেন, আমাদের একটি ওয়ার্ডে সিট রয়েছে ৬০ জনের। কিন্তু বর্তমানে রোগী রাখতে হচ্ছে ১৮০ থেকে ২৩৫ পর্যন্ত। সেই অনুযায়ী ওয়াশরুম ও ক্লিনার নেই৷ ওয়াশরুম সংখ্যা বাড়ানোর দায়িত্ব গণপূর্ত বিভাগের। আমরা তাদের চিঠি দিয়েছি।

এদিকে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন সূত্রে জানা গেছে, শুধু ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ৯০ জন। চমেক হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তির সংখ্যা ৪০ জন। ২৫০ শয্যার চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৮ জন। এছাড়া বিআইটিআইটিতে আছে ১৭ জন। ২৪ ঘন্টায় মারাও গেছে ১ জন। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট মৃত্যু ১৪ জনের। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৩০৩ জন।

যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম মেডিকেলের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ জয় আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, যাদের জ্বর বেশি, বমির ভাব লাগে, খেতে পারে না রুচি নেই, প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে, শরীর দুর্বল তারাই মূলত হাসপাতালের আসছেন৷ এছাড়া অনেকের ফুসফুসের পর্দায় পানি জমে যাচ্ছে। যা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের একটা ক্লাসিকাল কমপ্লিকেশন। আমরা তাদের টিপিক্যাল ডেঙ্গু পেশেন্ট হিসেবে কাউন্ট করছি৷

তিনি বলেন, ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে ঝুঁকিতে আছে বয়স্ক ও শিশুরা। আক্রান্ত অনেকের প্লাটিলেট আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায় এবং পেসার কমে গেলে আর উপরে তোলা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এছাড়া যাদের মাল্টিঅর্গান ডিসফাকশন আছে এবং যারা অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে তাদের আইসিইউ পর্যন্ত যেতে হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, বেশিরভাগ রোগী হাসপাতালে আসে চতুর্থ-পঞ্চম দিনে। এর মধ্যে অনেকের পঞ্চম দিনে জ্বর কমে যাচ্ছে। প্লাটিলেট যাদের কমেনি তারা বাসায় চলে যাচ্ছে। আর যাদের ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট হচ্ছে না তাদের হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে৷ তবে জ্বর হলে আতঙ্কিত না হয়ে ডেঙ্গু টেস্ট করে চিকিৎসক শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

এদিকে চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রজত শংকর রায় বিশ্বাস আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, আমাদের ৯০ শয্যার মেডিসিন বিভাগের ইনডোরে এখন ২০ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছে। এছাড়া আউটডোরে প্রতিদিন ২০-২৫ জন হাসপাতালে আসছে চিকিৎসা নিতে। রোগীর মাত্রাতিরিক্ত জ্বর, বমি, প্লাটিলেট কমে যাওয়া এবং দুর্বল হয়ে পড়লে হাসপাতালে আনা হচ্ছে।

তিনি বলেন, আমরা ডেঙ্গুকে গ্রুপ এ, বি ও সি তিন ভাগে ভাগ করি। তবে বেশিরভাগ রোগী বি ক্যাটাগরির। গ্রুপ বি হচ্ছে যাদের জটিলতা আছে অর্থাৎ প্লাটিলেট কম, ব্লাড পেসার কম, বেশি বমি হওয়া, দুর্বল লাগা, বয়স কম বা বেশি ইত্যাদি। এছাড়া প্রেগন্যান্সি রোগীদেরও ওয়ার্ডে ভর্তি রাখছি। নিয়মিত প্লাটিলেট সংখ্যা জানতে রোগীদের সিবিসি টেস্ট করানো হচ্ছে। সেইসঙ্গে পরামর্শ দিচ্ছি তরল খাবার খেতে।

আরবি/আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!