ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন কারিকুলামে পাঠদান : কে কী বললেন

ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে চালু হয়েছে নতুন কারিকুলামে পাঠ্যবইয়ের পাঠদান। তবে এ কারিকুলামের বইয়ে পাঠদানে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন— ভুল তথ্য ও উচ্চতর অধ্যয়নের বিষয় এনে পড়ালেখাকে জটিল করার। তবে ২০১৬ সাল থেকে গবেষণা শুরু হওয়ার পর ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে এসে শিক্ষার্থীদের হাতে ওঠে নতুন কারিকুলামের এসব পাঠ্যবই।

কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবক জানান, আগের শিক্ষাবর্ষের বইগুলোর সঙ্গে কোনো মিল নেই আধুনিক কারিকুলামের বইগুলোর। নতুন বইতে মলাট, নাম, বই সংখ্যা, বিষয়সহ বিস্তর পরিবর্তন করা হয়েছে। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ ঘটাতে নতুন রূপে বই বের করা হলেও সুপরিকল্পনার অভাবে নতুন কারিকুলামের বই নিয়ে আশার চেয়ে হতাশ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা।

ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বাংলা প্রথম ও দ্বিতীয়পত্র মিলে একটি বই করে নাম দেওয়া হয়েছে ‘বাংলা বই’। একইভাবে ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয়পত্র একসঙ্গে করে নাম দেওয়া হয়েছে ‘ইংরেজি বই’। এছাড়া অন্যান্য সব বইয়ের নামে আনা হয়েছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। বইকে সাজানো হয়েছে গল্পের ছলে অনেকটা বাস্তবভিত্তিক পড়ালেখায়।

নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও নতুন পদ্ধতি এনেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। বছরে ধারাবাহিক মূল্যায়নের সঙ্গে ৬ মাস আর ১২ মাসব্যাপী দুবার হবে সামষ্টিক মূল্যায়ন। কোনো নম্বর বা গ্রেড নয়; প্রারম্ভিক, অন্তবর্তীকালীন আর সর্বোচ্চ— এই তিন ধাপে হবে শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতার মূল্যায়ন। আর ফল প্রকাশ করা হবে নির্দিষ্ট একটি অ্যাপসের মাধ্যমে।

নতুন কারিকুলামের পাঠ্যবই প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক মু. সিরাজুল ইসলাম আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের কীভাবে পাঠদান হবে, প্রশ্ন কেমন হবে, কীভাবে পরীক্ষা হবে— সে বিষয়ে আমাদের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ চলছে। ফিল্ডওয়ার্ক হয়েছে।

নতুন কারিকুলাম শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য কিছুটা জটিল ও শিক্ষার্থীবান্ধব কি-না এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমরা মন্তব্য করতে পারবো না। কারণ এটি সম্পূর্ণ সরকারের হাতে। পাঠ্যবই নিয়ে যারা গবেষণা করেন তারাই মন্তব্য করতে পারবেন। এটি আমাদের কাজ না। আমাদের যেভাবে দেওয়া হয়েছে সেটিই আমরা গ্রহণ করেছি।

একই প্রসঙ্গে ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহেদা আক্তার আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, নতুন কারিকুলামের বইগুলোতো আমাদের কাছে একবারেই নতুন। আমরা এখনো বইগুলো ভালোভাবে দেখিনি। সেজন্য আমি এর বেশি মন্তব্য করতে পারবো না। তবে আমাদের ক্লাস চলমান রয়েছে। বাচ্চারা আনন্দের সাথে ক্লাস করছে। নতুন কারিকুলামের পাঠদানের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে, আমরা সেভাবেই পাঠদান চালিয়ে যাচ্ছি।

এদিকে গত কয়েকদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নতুন কারিকুলামের পাঠ্যবইয়ের নানা অসঙ্গতি নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে— সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞানের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের (তৃতীয় পৃষ্ঠা) শুরুতে তুলে ধরা হয়েছে, জীববৈচিত্র্য কী? এই প্রশ্নের উত্তর হুবহু ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ডট ওআরজি থেকে ভাষান্তর করে লেখা হয়েছে। যাকে বলা হয় প্লেজারিজম বা চৌর্যবৃত্তি।

ফেসবুকে আরেকজন লিখেন— নতুন কারিকুলামের পাঠ্যবইয়ে ভুলও কম নয়। ভুল তথ্য, ভুল মতবাদসহ ভুলের ছড়াছড়ি নতুন কারিকুলামের বইগুলোতে। ‘বখতিয়ার খলজি অসংখ্য বিহার ও লাইব্রেরী ধ্বংস করেছেন’- এরকম অসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েই লেখা হয়েছে এবারের স্কুলের পাঠ্যবইয়ে।

নতুন কারিকুলাম কতটা শিক্ষার্থীবান্ধব— প্রশ্ন করা হলে কোচিং শিক্ষক শরীফ বাপ্পি বলেন, নতুন কারিকুলাম করেছে বাস্তবভিত্তিক। সব পড়া বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে করার চেষ্টা করা হয়েছে। মুখস্থ নির্ভরতা একেবারেই বাদ। কোনো গাইডের প্রয়োজন হবে না। বাস্তব উদাহরণ ও বাস্তব ঘটনার সঙ্গে মিল রেখে করায় ছাত্রছাত্রীদের বুঝতে সুবিধা হবে। তবে এই কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ হবে হবে উন্নত। আমাদের দেশে এক এক ক্লাসে শিক্ষার্থী থাকে ৯০ থেকে ১০০ জন। এক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের মূল্যায়ন করা এবং তাদের বাস্তবভিত্তিক উপায়ে পাঠদানের সুযোগ খুবই কম থাকবে।

তিনি বলেন, শিক্ষকদের কাছে ৬০ শতাংশ নম্বর থাকায় গাইডনির্ভরতা বাদ দেওয়া গেলেও শিক্ষকদের ওপর নির্ভরতা অনেক বেড়ে যাবে। অর্থাৎ শিক্ষকদের কোচিং ব্যবসার জায়গায় আরো বেশি সুযোগ সৃষ্টি হবে। অনেক স্কুলে এখনই দেখা যাচ্ছে, যে শিক্ষক কখনো কোচিংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না, তিনিও কোচিং খুলে বসে গেছেন। আর শিক্ষার্থীদের ৬০ শতাংশ নম্বরের ব্যাপারে ভয় দেখাচ্ছেন। সিলেবাসে অনেককিছু কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেকারণে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী প্রয়োজনীয় সিলেবাস পাচ্ছে কি-না সন্দেহ আছে। আর যদি এই পরীক্ষামূলক পদ্ধতি ফেইল করে, তাহলে হয়ত আবার বই কিংবা কারিকুলাম পাল্টানো যাবে। কিন্তু ষষ্ঠ, সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের এক বছরের হারানো সময় কি ফিরিয়ে দেওয়া যাবে?

চট্টগ্রাম গরীবে নেওয়াজ উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী আরধি বলেন, নতুন বইয়ে কিছুই বুঝতে পারছি না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও তেমন পড়াচ্ছে না শিক্ষকেরা। মাস গেলে ঠিকই পরীক্ষা হবে৷ এবারের বই একেবারেই নতুন। অনেক কঠিন ভাষা, কঠিন বিভিন্ন বিষয় আনা হয়েছে বিজ্ঞান, সমাজ ও ধর্মশিক্ষায়। যা আমাদের জন্য একধরনের চাপের।

চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী মুনতাসির বলেন, নতুন বইয়ের সঙ্গে আগের শিক্ষাবর্ষের পাঠের কোনো মিল নেই। এখানে মূল পড়ালেখার বাইরে অনেক বিষয় দেওয়া হয়েছে। যেগুলো উচ্চতর অধ্যয়নের জন্য হলে ঠিক ছিল। কিন্তু এখন তা আমাদের পড়তে হবে। এসব বিষয় আমাদের জন্য জটিল। এছাড়া কোচিং, স্কুল, প্রাইভেট টিউটর— কেউই নতুন কারিকুলামে অভ্যস্ত না। তাই আমাদের কষ্ট হচ্ছে।

মুসলিম হাই স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীর অভিভাবক হাফসা বলেন, নতুন বইয়ের কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না আমার সন্তান। তাই এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি ৷ কয়েকজন অভিভাবককে তো দেখালাম, পড়া কঠিন হওয়ায় সন্তানের ভালো ফলাফলের জন্য বাড়তি প্রাইভেট টিউটর রেখেছেন। আমার মনে হয়, যথেষ্ট পরিকল্পনা ছাড়া নতুন কারিকুলামে পাঠদান শুরু করাটা ঠিক হয়নি।

এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মু. ফরিদুল আলম হোসাইনী আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, এ ব্যাপারে শিক্ষকদের ট্রেনিং কর্মসূচি সম্পন্ন করা হয়েছে। ৬ জানুয়ারি থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত শিক্ষকদের ট্রেনিং হয়েছে। প্রায় ৯৫ শতাংশ শিক্ষক যারা সফটওয়্যারে রেজিস্ট্রেশন করেছেন, তারা সবাই ট্রেনিংয়ের আওতায় এসেছেন৷ বাকিরাও পরবর্তীতে ট্রেনিংয়ের আওতায় আসবেন।

নতুন কারিকুলামের বইয়ে বিভিন্ন জটিলতা ও ভুলের ব্যাপারে তিনি বলেন, ২০১৬ সাল থেকে এই কারিকুলামের গবেষণা চলছে। সর্বস্তরের শিক্ষক এবং যারা এটি নিয়ে কাজ করে সবার সঙ্গে আলোচনা করেই এটি করা হয়েছে। ২০২৩ সালে এসে নতুন কারিকুলামের পাঠ্যবইয়ে পাঠদান শুরু করা হয়েছে। যারা বই নিয়ে গবেষণা করেছেন তারা অবশ্যই শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ, আধুনিক শিক্ষা, মানোন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয় চিন্তা করেই নতুন কারিকুলামে পাঠদানের জন্য বইগুলো অনুমোদন দিয়েছেন।

নতুন কারিকুলামের পাঠ্যবইয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ফিডব্যাক প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষকেরা ট্রেনিং করেছেন। শিক্ষার্থীরা আনন্দের সঙ্গে ক্লাস করছে। আমাদের ফিডব্যাক যথেষ্ট ভালো। আমাদের শিক্ষকরাও নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের সানন্দে পাঠদান করাচ্ছেন।

এসআই/আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!