বিএম ডিপো বিস্ফোরণ—২৩ দিনেও খোঁজ মেলেনি আবুল হাসেমের, দায় নিচ্ছে না কেউ

‘বিএম ডিপোতে আগুন লেগেছে। মাল আনলোড হবে না। দুই ঘণ্টার মধ্যে ঘরে ফিরছি।’

এটিই ছিল পরিবারের সঙ্গে আবুল হাসেমের শেষ কথা। কিন্তু ঘটনার তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও ঘরে ফেরেননি আবুল হাসেম। এমনকি পরিবারের ডিএনএ দেওয়ার পরও শনাক্ত হয়নি মরদেহ।

এদিকে নিখোঁজ আবুল হাসেমের স্ত্রী মোসলেমা আক্তারের অভিযোগ— ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দেওয়ার পর যোগাযোগ করলে কোনো সহায়তা দেওয়া হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ।

যখন কথা বলছিলেন তখন মোসলেমার দুচোখে ঝরছিল অশ্রু। মোসলেমার মতো আরো অনেকেই প্রতিনিয়ত খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদের নিখোঁজ স্বজনকে।

স্ত্রী, দুই কন্যা ও এক ছেলে নিয়ে ছিল আবুল হাসেমের পরিবার। নুসরাত লজিস্টিকের ড্রাইভার হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনার আগের দিন শুক্রবার রাতে তিনি ময়মনসিংহ পাইওনিয়ার নাইটওয়্যারস লিমিটেডের শিপমেন্ট নিয়ে বিএম ডিপোতে আসেন। সেদিন রাতে মাল আনলোড না হওয়ায় সীতাকুণ্ড ছোট কুমিরা ইলিয়াস পাম্পের পশ্চিম পাশে নতুন প্লট এলাকায় নিজ বাসায় ফিরেন বলে জানান স্ত্রী মোসলেমা।

মোসলেমা বলেন, ‘শুক্রবার (৩ জুন) রাতে তিনি (আবুল হাসেম) বাসায় ফিরেন। পরদিন (শনিবার) সকালে ঘরের বাজার করে সকাল ১০টার দিকে গাড়ি আনলোডের জন্য বিএম ডিপোতে চলে যান। ব্যস্ততার মাঝেও বেশ কয়েকবার কথা হয় তার সঙ্গে। রাত ১০টা ১৭ মিনিটে তিনি ফোন করে বলেন, বিএম ডিপোতে আগুন লেগেছে। মাল আনলোড হবে না। আমি দুই ঘণ্টার মধ্যে ঘরে ফিরবো। এটাই ছিল তার সঙ্গে শেষ কথা।’

‘ওইদিন রাত ১০টা ৪৭ মিনিটের দিকে কনটেইনার বিস্ফোরণের শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। এ সময় তাকে কল করা হলে ফোন বন্ধ পাই। এরপর থেকেই আজ অব্দি তার খোঁজ পাওয়া যাইনি। ঘটনার রাতে স্বজনরা চট্টগ্রাম মেডিকেলসহ বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে খোঁজ নেন। কিন্তু কোথাও তার খোঁজ মেলেনি— যোগ করেন মোসলেমা।

আরও পড়ুন: চট্টগ্রামে করোনা : আক্রান্ত সবাই নগরের

পরিবারের অন্য সদস্যরা জানান, চট্টগ্রাম মেডিকেলের সামনে ডিএনএ নমুনা দেন হাসেমের বাবা ছবির আহমেদ ও মা আয়েশা খাতুন। কিন্তু সেদিন তাদের কোনো রশিদ কিংবা নমুনা সংগ্রহের ডকুমেন্ট দেওয়া হয়নি।
গত ২২ জুন মরদেহ শনাক্ত হয়েছে কি-না জানতে পাঁচলাইশ থানায় যোগাযোগ করলে তারা জানে না বলেন। পরে পাঁচলাইশ থানা পুলিশের পরামর্শে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে গেলে এ বিষয়ে তারাও কোনো সহায়তা করতে পারেনি। এরপর সিএমপি ডিবি কার্যালয়ে গেলে তারা জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে যোগাযোগ করতে বলেন।

মোসলেমা বলেন, তার (স্বামীর) মরদেহ যেন শেষবারের মতো দেখতে পাই সেই আশায় এখনো বিভিন্ন জায়গায় ঘুরছি। তার উপার্জনে চলত আমাদের সংসার। বড় মেয়ে সালমা আক্তার অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। মেঝ মেয়ে সাইমা আক্তার ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ছোট ছেলে স্থানীয় এক মাদ্রাসায় তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। ভাড়া বাসায় থাকি। স্থায়ী কোনো বাড়িও নেই আমাদের। এখন তিন সন্তানের লেখাপড়া ও পরিবার চালাতে আমার অর্থ সহায়তা প্রয়োজন।

তিনি বলেন, বিস্ফোরণের দিন বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিলেন। সেই আশ্বাসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করি। শিপমেন্ট নিয়ে আসা হাসেমের পোড়া ট্রাকটির ছবিও দেওয়া হয় ডিপো কর্তৃপক্ষকে। একইসঙ্গে সেদিনের গাড়ির চালানটিও। কিন্তু তারা মৃত্যু সনদ ও ডিএনএ রিপোর্ট খোঁজেন। এদিকে আমরা মরদেহ পায়নি। মৃত্যু সনদ কীভাবে দেব? তাছাড়া ডিএনএ সংগ্রহের পর আমাদের কোনো রশিদও দেওয়া হয়নি। এ সময় সিনিয়র এক্সিকিউটিভ একাউন্টেন্ট তায়েব হিরো নামে কর্তব্যরত বিএম ডিপোর এক কর্মকর্তা কোনো সহায়তা দেবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন। তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে আমরা কাজ করছি। পরবর্তীতে যদি বহিরাগতদের সহায়তা দেওয়া হয় আপনাদের জানানো হবে।

আরও পড়ুন: পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের উৎসবে সবাই সুর মেলালেও ব্যতিক্রম চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিএম কনটেইনার ডিপোর পরিচালক মুজিবুর রহমান বলেন, যারা নিখোঁজ ও মারা গেছেন যথাযথ কাগজপত্র দিলে তাদের পরিবারকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। হোক বিএম ডিপোর কর্মচারী বা বাইরের। ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষতিপূরণ পাবে।

কর্মচারী হিরোর বিষয়টি জানালে তিনি নির্বাহী পরিচালক শহীদ উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, হিরো ছেলেটা মানসিক রোগী। তার কোনো কথা আমলে নেওয়ার দরকার নেই। এরপর তিনি মিটিংয়ে আছে জানিয়ে দ্রুত কল কেটে দেন।

এদিকে ক্ষতিগ্রস্তদের কাগজপত্র জমা নেওয়ার কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা সিনিয়র এক্সিকিউটিভ একাউন্টেন্ট তায়েব হিরোর সঙ্গে কথা হয়। তিনি আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, মৃত্যু সনদ ও ডিএনএ পরীক্ষার সনদ দিলে তাদের সহযোগিতা করা হবে। এছাড়া আরো ৭ থেকে ৮ জনের এমন সমস্যার বিষয়ে ফাইল জমা পড়ে আছে আমাদের কাছে। আবার অনেকে যোগাযোগও করেনি।

আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!