‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিতর্ক’ চট্টগ্রামে হিন্দুদের ঐক্যে ফাটল, দুষছেন একে অপরকে

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন প্রধান অতিথি থাকার কারণে নগরের জেএম সেন হলে জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদের অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা হয়েও উপস্থিত হননি অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত। এর পরিবর্তে তিনি কালো পতাকা মিছিল করেছেন। তবে রানা দাশগুপ্ত ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুখোমুখি হলে সব বিতর্কের অবসান হতো বলে মনে করেন জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদ নেতারা।

এদিকে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধাচরণকারীর সঙ্গে একই মঞ্চে বক্তব্য রাখতে চান না বলে জানিয়েছেন।

এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চট্টগ্রামে আগমনের প্রতিবাদে নগরের চেরাগি পাহাড় চত্বরে কালো পতাকা মিছিল ও সমাবেশ হয়। সংখ্যালঘুদের নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের বক্তব্যের জের ধরেই এ মিছিল করা হয়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘দেশের বাইরে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন নিয়ে গণমাধ্যমে যে প্রচার করা হয় বা হিন্দু জনগণ যে ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদ করে সেগুলো মিথ্যা। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন হয়নি, এদেশের সংবাদমাধ্যম ও সংখ্যালঘুরা নির্যাতন নিয়ে মিথ্যাচার করে।’

যোগাযোগ করা হলে জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদ সভাপতি সুকুমার চৌধুরী আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, ‘দশ কথার এক কথা, আমরা নিজেদের ঘরে নিজেরা আগুন লাগাবো না। নেত্রী (শেখ হাসিনা) বিব্রত হয় এমন কাজও করবো না। একটা কথা ভুল হতেই পারে। আপনারা যেটা বলতে চাইছেন সেটা আমি জানি।’

আরও পড়ুন: ভুল তথ্যের রিপোর্ট—মানবাধিকারে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ, বললেন তথ্যমন্ত্রী

কেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেনকে অতিথি করে এনেছেন—এ বিষয়ে সুকুমার চৌধুরী বলেন, আবদুল মোমেন সাহেবের সঙ্গে কথা বলার সময় আমাদের বক্তব্য ছিল, আপনি আপনার বক্তব্য ক্লিয়ার করবেন। আপনাকে নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় আছি, আমরা মনে করছি প্রধানমন্ত্রী বিব্রত হচ্ছেন। যদিও প্রধানমন্ত্রী মুখে কিছু বলেন না, উনি চুপচাপ থাকেন। কিন্তু আমরা অস্বস্তি বোধ করছি। আপনি বিদেশে গিয়ে বিতর্কিত যে কথাগুলো বলেছেন, সেগুলো আপনি ক্লিয়ার করবেন। এ সময় আব্দুল মোমেন সাহেব আমাদের বুঝিয়ে বলেন, আমরা যেখানে যাই মিডিয়া ধরে থাকে। অনেক সময় কিছু মিডিয়া উল্টাপাল্টা করে ফেলে। আমি যেটা করেছি, আমি এক বছর আগে একটা কথা বলেছি। পরে এসে সেটা দেখছি এমন ঘটে গেছে।

সুকুমার চৌধুরী বলেন, এ সময় আবদুল মোমেন সাহেবকে বলেছি, আপনি আপনার বিষয়টি ক্লিয়ার করবেন। তিনি আমাদের সঙ্গে সহমত পোষণ করে বলেন, ঠিক আছে।

তিনি বলেন, এরপর আমাদের অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা রানা দাশগুপ্তের সঙ্গে আমাদের কথা হয়। এ সময় আমি রানা দাশগুপ্ত মহোদয়কে অনুরোধ করে বলেছি, আপনি আসেন। প্রতিবাদ করিয়েন না। আগে উনার কাছে আসেন, উনি কি বলে দেখেন। আপনি আপনার বক্তব্য দেন। এরপর আবদুল মোমেন সাহেব ওনার বক্তব্য দেবেন। জনগণ তারপর বিচার করবে।

অনুরোধের বিপরীতে রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘আমি আর ওই স্টেজে উঠবো না।’ কিন্তু রানা দাশগুপ্ত যদি স্টেজে না ওঠে এটা আমাদের ক্ষতি। তাছাড়া রানা দাশগুপ্তরা আন্দোলন করলে কি? আপনি কি সরকারের পতন চান? আমরাতো সরকারের পতন চাইতে পারি না, তাই না? আপনি বিষয়টি এমনভাবে করেন যেন সরকার বিব্রত না হয়।

কালো পতাকা দেখিয়ে মিছিল করার বিষয়ে সুকুমার চৌধুরী বলেন, এরপর তারা যে অন্যায় কাজটা করল সেটা আমরা সমর্থন করিনি। তারা ১৫ থেকে ২০ জন লোক কালো পতাকা দেখিয়ে মিছিল করল। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে ঘটনাটি ঘটেছে।

রানা দাশগুপ্ত যদি সেদিন প্রোগ্রামে থাকতেন সবকিছু মিটে যেত। কিন্তু তিনি এসব মেটাবেন না। তিনি আগুন জ্বালাবেন। আর আগুন না জ্বালালে উনার দাম থাকবে?— যোগ করেন সুকুমার চৌধুরী।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেনের বিষয়ে সুকুমার চৌধুরী বলেন, আমার মনে হল আবদুল মোমেন মানুষটা ভালো। কেন? তার সরল বিশ্বাস, সরল কথাবার্তা; আমার কাছে অন্যরকম লাগেনি। আমি যখন বলেছি, রানা দাশগুপ্ত আপনার সাঙ্গে কথা বলবে। প্রতিউত্তরে তিনি বলেন, ‘কোনো অসুবিধা নেই। যেটা বলবেন, সেটার জবাব আমি দেবো।’

তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রোগ্রাম শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে আমি জানতে চাইলাম, আমাদের এখানে আপনিতো অনেক কিছুর সম্মুখীন হলেন, আমি ডাকলে আপনি আবার আসবেন? তিনি বলেন, ‘আমি কথা দিচ্ছি, আপনি যখন ডাকবেন তখনই আসব।’

এদিকে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, ‘জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদের অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচক হিসেবে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আমিও কিন্তু প্রধান আলোচক হিসেবে থাকার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু ১৭ আগস্ট রাত ১১টায় আমি জানতে পারলাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ১৮ আগস্টের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আসবেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিন্দু জনগোষ্ঠীর স্বার্থবিরোধী হয়ে বিদেশে বেশকিছু বক্তব্য রেখেছেন। এজন্য সিদ্ধান্ত নিলাম, ওনাকে কালো পতাকা মিছিল করে আমরা ধিক্কার জানাবো, তবে উৎসব উদযাপন পরিষদের কোনো কর্মকাণ্ডকে ব্যঘাত না করে। আমাদের ফাইট শুধু পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আগমনের প্রতিবাদে।’

রানা দাশগুপ্ত বলেন, জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদের সভাপতি সুকুমার চৌধুরী ১৮ আগস্ট আমাকে বলেন, দাদা আপনি ১৯ আগস্টের প্রোগ্রামে আসেন। সেসময় আমি ওনাকে বলেছি, যে মঞ্চে হিন্দু স্বার্থবিরোধী ব্যক্তি প্রধান অতিথি হিসেবে থাকে, ওই মঞ্চে আমি উঠতে পারবো না। এটা হচ্ছে অন প্রটেস্ট। প্রটেস্ট নট অ্যাগেইন্সট উৎসব। প্রটেস্ট অ্যাগেইন্সট দি প্রেজেন্স অব ফরেন মিনিস্টার।

তিনি বলেন, ‘মিছিল বের না করার ধৃষ্টতা আমাকে কেউ দেখাবে না। কারণ আমি যা করি সেটা সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার জন্য। আমি একদিকে যার প্রতিবাদ করবো আরেকদিকে তার সঙ্গে থেকে মঞ্চে বক্তব্য রাখবো, এটা আমার ধাঁচে নেই।’

এ সময় তিনি আরও বলেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখোমুখি হওয়ার দরকার নেই। আমি যে মুখোমুখি হয়েছি, ওটাতো বাংলাদেশ জেনে গেল। আমি খুশি হতাম, এত লোক থাকতে এরকম একটি লোককে যদি প্রধান অতিথি হিসেবে না আনা হতো। আমি জানি না, কারা এ কাজটি করিয়েছে।’

রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘এর মধ্যদিয়ে সবাইকে একটি ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করলাম, যে আপনারা সরকারিবিরোধী দলে অথবা কর্ম নেতৃত্বে, যে যেখানে থাকুক না কেন সংখ্যালঘুর স্বার্থবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ড বা বক্তব্য যদি দেন তাহলে সংখ্যালঘুরা এদের গ্রহণ করবে না। এটি শুধু কালো পতাকা কর্মসূচি না, এটি একটি প্রতিবাদ, অধিকারের প্রশ্নে।’

আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!