চট্টগ্রামে ‘ভয়ঙ্কর’ ডেঙ্গু—ভয় বাড়াচ্ছে মৃত্যু, ওষুধ ছিটিয়ে দায় সারছে সিটি করপোরেশন

চট্টগ্রামে শঙ্কা বাড়িয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। ভয় বাড়িয়ে বাড়ছে মৃত্যু। চট্টগ্রামে সেপ্টেম্বর–অক্টোবর মাসজুড়ে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে৷

সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালেও বেড়েছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। মাত্র ৩-৪ দিনের জ্বরে প্রাণ হরণ করছে এবারের ডেঙ্গু৷

এদিকে ডেঙ্গু রোগী ও মৃত্যু বাড়লেও মশার ওষুধ ছিটিয়ে দায় সারছে সিটি করপোরেশন করপোরেশন (চসিক)। এ অবস্থায় চসিকের মশক নিধন কার্যক্রম নিয়ে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ।

নগরবাসীর অভিযোগ, মশা নিধনে যেসব ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে মশা মরছে না। এছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডের সব এলাকায় মশার ওষুধ ছিটানো হয়নি। আবার ওষুধ একদিন ছিটালেও এরপর আর খোঁজ থাকে না।

চট্টগ্রামে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১৪ জন। সর্বশেষ ২৮ অক্টোবর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রাম কলেজের ডিগ্রি পড়ুয়া শিক্ষার্থী জাকারিয়া হোসেন তুষার মারা যান চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে।

এখন পর্যন্ত চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ১৪ জন। এর মধ্যে ৩ জন পুরুষ, ৭ জন নারী ও ৪ জন শিশু।

গত ২২ সেপ্টেম্বর একদিনেই ৩ ডেঙ্গু রোগী মারা যান। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিউলি রানী (৪০) ও খুরশিদা বেগম (৭০) এবং এভারকেয়ার হাসপাতালে দিল আরা বেগম (৫০) নামে একজনের মৃত্যু হয়৷

গত ২৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পার্ক ভিউ হাসপাতালের আইসিইউতে মিফতাহুল জান্নাত (৯) নামে এক শিশু ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
একইদিন নগরের এক বেসরকারি হাসপাতালে মিজানুর রহমান (২৬) নামে এক ডেঙ্গু রোগী মারা যান।

সবমিলিয়ে সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৫ জনের মৃত্যু হয়। আর অক্টোবরে সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৯ জন। সর্বশেষ গত ২৮ অক্টোবর ভোরে চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে জাকারিয়া হোসেন তুষারের মৃত্যু হয়।

জানা যায়, নগরের বেশ কয়েকটি জায়গা ডেঙ্গুর হটস্পট হয়ে উঠেছে৷ ডবলমুরিং, বন্দর, দেওয়ানহাট, হালিশহর ও আগ্রাবাদ এলাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি।

জেলা সিভিল সার্জনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে আরো ৩১ জনের দেহে ডেঙ্গু রোগের জীবাণু পাওয়া গেছে। এ নিয়ে গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ৩৭৫ জন। সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন ১ হাজার ২৭৯ জন এবং বেসরকারি হাসপাতালে ১ হাজার ৯৬ জন। এছাড়া ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ গেছে ১৪ জনের।

জেলা সিভিল সার্জনের দেওয়া হিসাবের বাইরেও ডেঙ্গু রোগে মারা যাচ্ছে অনেক রোগী। অল্প কয়েকদিনের জ্বরে পরীক্ষা করার আগেই প্রাণ চলে গেছে অনেকের।

সরেজমিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায় ডেঙ্গুর ভয়াবহতা৷

নগরের মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ড এখন ডেঙ্গু রোগীতে ঠাসা৷ প্রতিদিন ২০-২২ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগী এখানে চিকিৎসা নিচ্ছে।

নগরের বেসরকারি পার্ক ভিউ হাসপাতালের জিএম তালুকদার জিয়াউর রহমান শামীম আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, আমাদের হাসপাতালে এখন ১২ জন রোগী ভর্তি আছে। একজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে এখন পর্যন্ত। সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

জানতে চাইলে চসিকের ভারপ্রাপ্ত প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা আবুল হাসেম আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, আমরা এখন ‘মসকুবান’ নামের একটি ওষুধ ব্যবহার করছি। এটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা দল আমাদের ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে। এছাড়া আগের ওষুধ যেগুলো ব্যবহার করেছি সেগুলো আমরা আবার পরীক্ষা করে নিয়েছি। সেইসাথে আমরা জনবল বাড়িয়েছি। আগে ১২০ জন ছিল, এখন তা ২৬০ জন। গত সপ্তাহে আমরা নতুন ১০০টা স্প্রে মেশিন কিনেছি।আমরা প্রায় সব ওয়ার্ডে প্রতিদিন মশার ওষুধ ছিটানোর কাজ করছি। ৪১টি ওয়ার্ডকে ১০টা ব্লকে ভাগ করে এ কাজ চালাচ্ছি আমরা। প্রতি ওয়ার্ডে একসাথে ৬০ জন লোক নিয়ে কাজ করছি। একবার ওষুধ ছিটানোর পর ব্লক ঘুরে আসতে আসতে ৭ দিন ছিটানো হয় না। তবে ব্লক শেষ করে আমরা যখন আবার আসি তখন আবার ছিটাই। গত এক মাসে আমরা ৪০ লাখ টাকার ওষুধ ছিটিয়েছি, যা এর আগে ৬ মাসেও দেওয়া হয়নি।

নতুন ওষুধের কার্যকারিতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, নতুন ওষুধ আমরা ৩ দিন হলো ব্যবহার করছি। অন্তত ৭ দিন না হলে এর কার্যকারিতা সম্পর্কে বলা যাচ্ছে না।

যোগাযোগ করা হল চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. হুমায়রা কানিজ আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, আমাদের হাসপাতালে প্রতিদিন ২০-২২ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। এবার ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি, সেইসাথে রোগীদের মাঝে নতুন নতুন উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। যাদের বয়স কম এবং বয়োবৃদ্ধ তারা একটু ঝুঁকিতে থাকে৷ এছাড়া ডেঙ্গুর পাশাপাশি অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হলে দ্রুত প্লাটিলেট কমে যায়, সেক্ষেত্রে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। রোগীকে এ পুরো সময়জুড়ে পর্যাপ্ত তরল খাবার খেতে হবে। সেইসাথে জ্বর হলে ডেঙ্গু টেস্ট করে চিকিৎসা শুরু করতে হবে৷

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. ইলিয়াস চৌধুরী আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, আমাদের কিছু করার নেই। আমরা উপদেশ দিয়ে যাচ্ছি। বাকিটা যা করার সিটি করপোরেশন করবে। আইইডিসিআর থেকে যে উপদেশ দেওয়া হয়েছে সিটি করপোরেশনকে তাদের গবেষণাপত্র পাঠানো হয়েছে। মেয়র, ডিসি, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ে আমরা সে উপদেশ পাঠিয়ে দিয়েছি। আইইডিসিআর’কে আমরা ডেকে এনেছিলাম গবেষণা করতে, কোথায় কোথায় আছে এগুলো দেখার জন্য। আমাদের যা দায়িত্ব ছিল আমরা সেগুলো সম্পন্ন করেছি।

ডা. ইলিয়াস চৌধুরী বলেন, আমাদের মূল দুর্ভাগ্য হচ্ছে, থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। এটি যতদিন বন্ধ হবে না ততদিন পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। পরিষ্কার পানি তিনদিন যেখানে জমবে সেখানে এডিস মশার লার্ভা জন্মাবে। মোটর গ্যারেজ, গাড়ির গ্যারেজ, ফুলের টব, টায়ার, নির্মাণসামগ্রী— এগুলো আইইডিসিআর চিহ্নিত করেছে। আমাদের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এবার অন্যান্য বছরের তুলনায় শিশুদের ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। তাই শিশুদের ওপর বিশেষ খেয়াল রাখা জরুরি।

আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!