কেইপিজেডে চলছে পাহাড় কাটার যজ্ঞ, দেয়াং পাহাড় এখন আরেক ‘ইতিহাস’

আনোয়ারায় অনেকটা ফ্রি স্টাইলে পাহাড় কেটে কারখানা করছে কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড) কর্তৃপক্ষ। এতে একদিকে ধ্বংস হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য, অন্যদিকে বন্য প্রাণী হারিয়ে ফেলছে আবাসস্থল। এ অবস্থায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দেয়াং পাহাড়ের অপার সৌন্দর্য।

কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে অবস্থিত কেইপিজেড। যার ৮০ শতাংশই পাহাড়ি ভূমি। পাহাড় কেটেই গড়ে তোলা হচ্ছে একের পর এক শিল্প কারখানা। এতে ধ্বংস হচ্ছে এখানকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য।

একদশক ধরেই কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ নির্বিচারে পাহাড় কাটছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা বলেন, প্রায় আড়াই হাজার একর ভূমিতে গড়ে তোলা কেইপিজেডের কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান দৌলতপুর এলাকার কেইপিজেড অঞ্চল, আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের মধ্য বন্দর, উত্তর বন্দর, মোহাম্মদপুর, ফকিরখিল এবং হাজিগাঁও এলাকায় পাহাড় কাটছে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ।

দিন-রাতে খননযন্ত্র দিয়ে বড় উঠান এলাকা থেকে আনোয়ারা বৈরাগ পর্যন্ত উঁচু পাহাড় কেটে মাটি তুলে সমতল করা হচ্ছে। ফলে নদীতীরের দেয়াং পাহাড়ের অপার সৌন্দর্য এখন বিলুপ্তির পথে। বাকি যে টিলা-পাহাড়গুলো রয়েছে সেগুলো কেটে মাটি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে ভরাট করে গড়ে তোলা হচ্ছে কারখানা, বিল্ডিং ও রাস্তা।

তবে এ কথা মানতে নারাজ কেইপিজেডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) মুশফিকুর রহমান। তিনি আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, আমাদের জোনে বর্তমানে ৪৫টি নতুন কারখানা গড়ে উঠছে। এর মধ্যে আমেরিকান সিলিকন কোম্পানি একটি আইটি ভ্যালির আওতায় ২২ তলা বিশিষ্ট ২৭টি ভবন নির্মাণ করছে। এসব ভবন নির্মাণে কর্তৃপক্ষ নিচু এলাকাগুলো ভরাট করছে উঁচু টিলা কেটে।

তিনি বলেন, এখানে কোনো পাহাড় নেই। পাহাড় বলতে যা বোঝায় তার মধ্যে একটিও নেই কেইপিজেড এলাকায়। টিলা কেটে আগে যেমন আমাদের অন্তত ২০টি কারখানা বানানো হয়েছে তেমনই একইভাবে বাকি কারখানার কাজ চলছে।

জোনের মূল ফটকের কাছেই পাহাড় কাটা এখনও চলছে— এমন কথার জবাবে তিনি বলেন, ওখানে একটি লেক করা হচ্ছে। সে কারণে মাটি কেটে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এখানে কোনো পাহাড় কাটা হচ্ছে না।

স্থানীয়রা বলছেন, ওই এলাকার চারপাশ পাহাড়ঘেরা। যেখানে কাটা অংশ অনেকদূর থেকেও দৃশ্যমান। এর বাইরে কারখানার উত্তর পাশে অনেক উঁচু একটি পাহাড় কাটা হচ্ছে। ভরাট চরছে নিচের ছড়াও। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মুশফিকুর রহমান বলেন, হ্যাঁ ওখানে আইটি ভ্যালি গড়ে তোলা হবে। এ কারণে নিচু এলাকা সমান করা হচ্ছে। আর যে পাহাড় কাটা আপনারা দেখেছেন সেটি ইস্টার্ন রিফাইনারি একটি পাইপলাইনের জন্য কেটেছে। এটা আমরা কাটিনি।

কারখানার মূল কার্যালয়ের ২০০ মিটারের মধ্যে একটি ভবন গড়ে তোলার কাজে ভরাট অংশের মাটিগুলো কোথা থেকে আসছে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে আমরা যেখানে কারখানা বা অফিসের জন্য ভবন নির্মাণ করছি সেখানেই উঁচু টিলা রয়েছে। ওই টিলার উঁচু অংশ কেটে নিচু অংশ ভরাট করেই ভবন বা কারখানা বানানো হচ্ছে।

মুশফিকুর রহমান বলেন, কেইপিজেডের বরাদ্দ করা ভূমির পরিমাণ ২ হাজার ৪৯২ একর। যার পুরো এলাকায় রয়েছে উঁচু টিলা। এখানে কোনো পাহাড় নেই। বরং বরাদ্দ পাওয়ার আগে আমরা এ এলাকার পুরোটাই বিধ্বস্ত অবস্থায় পেয়েছি। বরাদ্দ পাওয়ার পর আমরা এলাকার ৫২ শতাংশ ভূমিতে বনায়ন করেছি, লেক করেছি, যার মাধ্যমে কেইপিজেডের প্রাকৃতিক পরিবেশ অনেক উন্নত হয়েছে। আগে কিন্তু এমনটা ছিল না।

বাকি ৪৮ শতাংশ জমিতে আমরা বাণিজ্যিক কারখানা করেছি। যেখানে চট্টগ্রাম ও আশপাশের ২৯ হাজার বেকার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এটা কি কম?— প্রশ্ন রাখেন মুশফিকুর রহমান।

তিনি বলেন, এরপরও যদি পাহাড় কাটার বিষয়ে এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে প্রশ্ন উঠে তাহলে সেটা কেমন দেখায়।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে বাংলাদেশের যেকোনো পরিবেশবিদের চেয়ে কোরিয়া অনেক বেশি অ্যাডভান্স। কোরিয়ার একটি টিম ইপিজেডের পরিবেশ রক্ষায় সার্বক্ষণিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যেখানে চবির ফরেস্ট্রি ও এনভায়রনমেন্ট বিভাগের একজন প্রতিনিধিও রয়েছেন।

এ বিষয়ে কথা বলতে চবির ফরেস্ট্রি ও এনভায়রনমেন্ট বিভাগের প্রতিনিধি প্রফেসর জসিম উদ্দিনের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

এদিকে পাহাড় কাটার বিষয়ে সরেজমিন পরিদর্শন করতে চাইলে কারখানার বিভিন্ন ফটকে কর্মরত নিরাপত্তাকর্মীদের বাধা আসে। তবে প্রতিনিধি কৌশলে সরেজমিন পরিদর্শন এবং পাহাড় কেটে ছবি তোলেন। ফিরে আসার পথে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ছবি তোলা হয়েছে কি-না তা মোবাইল বা ক্যামেরায় দেখাতে বলেন তারা।

এ সময় মাবুদ নামে এক নিরাপত্তা কর্মী বলেন, এখানে কোনো সাংবাদিককে ঢুকতে দেওয়া হয় না। জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা কোরিয়া, বাংলাদেশ না। এখানে বাংলাদেশের কেউ প্রবেশ করতে চাইলে কোরিয়ার অনুমতি লাগে।

এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মুশফিকুর রহমান বলেন, এটা ওদের ডিউটি ও নিরাপত্তার একটি অংশ। এমন নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকলে তো কারখানা থেকে অনেকে অনেককিছু বেরিয়ে যেত। আপনি হয়ত জানেন, এখান থেকে এক মুঠো মাটি যেমন বাইরে যায় না, তেমনি বাইরে থেকেও এক মুঠো মাটি ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না।

বিদেশি কোম্পানিকে কারখানা করতে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের বরাদ্দ পাওয়া জমিতেই তো আমরা বিদেশি কোম্পানিকে কারখানা করার অনুমতি দিয়েছি। এটা ইপিজেড চুক্তির একটি অংশ। সে হিসেবে আমরা যেকাউকে প্রোভাইড করতে পারব।

এদিকে পাহাড় কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে আনোয়ারার ইউএনও শেখ জোবায়ের আহমেদ আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, শিল্পায়নের নামে দেয়াং পাহাড়সহ কেইপিজেডের পাহাড়কে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলা হয়েছে। পরিবেশ রক্ষায় তারা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। হাইকোর্ট পাহাড় কাটা বন্ধ রাখার জন্য নির্দেশনা দেওয়ার পরও বন্ধ রাখেনি। ফলে হাইকোর্টের আদেশে গত ১ নভেম্বর পাহাড় কাটার কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যদিও পাহাড় কাটার কাজ আবারও শুরু করেছে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে।

সূত্র জানায়, ২০১২ সালে পাহাড় কেটে পরিবেশ ধ্বংসসহ পরিবেশ আইন লংঘনের অভিযোগ এনে কেইপিজেডের তিন শীর্ষ কর্মকর্তার পাশাপাশি অজ্ঞাত আরও সাত থেকে আটজনকে আসামি করে মামলা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। এর মধ্যে তিন কর্মকর্তা হলেন- কেইপিজেডের উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান নাসির, মহাব্যবস্থাপক অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল মো. শাহজাহান ও উপমহাব্যবস্থাপক আবুল কালাম আজাদ।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (ইনভেস্টিগেশন) আবদুর রাজ্জাক কর্ণফুলী থানায় এ মামলা করেন।

তিনি বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর ২০০৯ সালের ২৩ নভেম্বর ৩৩টি শর্তে কেইপিজেডকে পাহাড় কাটার অনুমতি দেয়। শর্তে লেখা আছে, অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী পাহাড় কর্তন ও মোচন করা যাবে। পাহাড়-টিলা কাটার আগে পরিবেশ অধিদপ্তরকে জানাতে হবে। কিন্তু এসবের কিছুই তোয়াক্কা না করে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে নির্বিচারে পাহাড় কাটছে। এসব নির্দেশ অমান্য করায় হাইকোর্ট পাহাড় কাটা বন্ধ রাখার জন্য নির্দেশ দেন।

একই প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা সফিকুল ইসলাম বলেন, কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ পাহাড়ের পাদদেশে টার্ফিং, স্ট্যাবিলাইজিং, সিল্ট ট্র্যাপ ইত্যাদি ব্যবস্থা না নিয়েই শিল্পায়নের নামে সমানে পাহাড় কেটে যাচ্ছে। দেয়াং পাহাড় যখন ছিল, তখন লোকালয়ে কখনো হাতি আসত না। কেইপিজেড একের পর এক পাহাড় কেটে শেষ করছে। এখন বন্য প্রাণীগুলো তাদের বাসস্থান হারিয়ে দিনদুপুরে চলে আসে লোকালয়ে। দেয়াং পাহাড় এখন নামে আছে, উঁচু পাহাড় সব কেটে সমতল করে ফেলা হয়েছে।

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আনোয়ারা উপজেলা চেয়ারম্যান এম তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, আমাদের ইউএনও সাহেব গিয়ে কেইপিজেডে পাহাড় কাটা বন্ধ করে দিয়েছেন। এরপরও তারা পাহাড় কাটা অব্যাহত রেখেছে। এভাবে কয়েক বছর পাহাড় কাটলে নিশানাও থাকবে না। পাহাড় হারিয়ে গেলে কিছুদিন পর জীবজন্তু সবই লোকালয়ে চলে আসবে। এছাড়া জলাধার ভরাটের কারণে বর্ষায় পানি নামে লোকালয়ে। এজন্য পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি স্থানীয়দের ভোগান্তি হয়। বিষয়টি নিয়ে আমি পুনরায় ইউএনও সাহেবের সঙ্গে কথা বলব। এ বিষয়ে অবশ্যই পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!