জামানত হারিয়েও গ্যাং লিডার থেকে কাউন্সিলর টিনু—টিআইবির ‘সংশয়’, ইভিএম নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড

রেকর্ড ২১ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন চকবাজার ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদের উপনির্বাচনে। সেই রেকর্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেক রেকর্ড। আরেকটু পরিষ্কার করে বললে, ‘লজ্জার রেকর্ড’।

চকবাজারে কাউন্সিলর প্রার্থী হওয়া ২১ জনই হারিয়েছেন জামানত! অর্থাৎ বিজয়ী কাউন্সিলরও হারিয়েছেন জামানত। বিজয়ী প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্তের ঘটনা দেশের ইতিহাসে এটিই প্রথম।

নির্বাচনের শুরুতে প্রার্থীদের ব্যাপক প্রচারণা করতে দেখা গেলেও সাধারণ মানুষের আগ্রহ ছিল কম। ‘জামায়াতের আঁতুড়ঘর’ হিসেবে পরিচিত চকবাজার ওয়ার্ডে দলীয় প্রার্থীর ছড়াছড়ি থাকলেও বিজয়ী হন ‘কিশোর গ্যাং’ লিডার হিসেবে চিহ্নিত কারাবন্দী নুর মোস্তফা টিনু।

আরও পড়ুন: চকবাজারের ‘অস্ত্রবাজ’ টিটুর হঠাৎ ‘সন্ত্রাসী’ টিনু হওয়ার গল্প

এদিকে চকবাজারের মতো একটি ওয়ার্ডে কম ভোটার উপস্থিতি এবং ফলাফল জালিয়াতির অভিযোগকে অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন সাধারণ মানুষ। টিআইবির মতে, ‘কিশোর গ্যাং’ নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ থাকা ব্যক্তি কারাগারে বসে কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হওয়াটাও শঙ্কার বিষয়।

চকবাজার ওয়ার্ডে সরকারদলীয় ক্লিন ইমেজের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনা চ্যালেঞ্জ ছিল। তবে দিনশেষে পুলিশ কাপাসগোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ইভিএম মেশিন নির্বাচন অফিসে নিয়ে যায়। পরে ফলাফল ষোষণার মাধ্যমে নুর মোস্তফা টিনুকে বেসরকারিভাবে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।

স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) নির্বাচনি বিধিমালা ২০১০ এর ৪৪ নম্বর ধারায় বলা আছে, ‘কোনো প্রার্থী নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের এক অষ্টমাংশ (আট ভাগের এক ভাগ ভোটের কম) অপেক্ষা কম ভোট পেলে তার জামানতের টাকা সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হবে।’

এ বিধি অনুযায়ী, চকবাজার উপনির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের এক অষ্টমাংশ হচ্ছে ৮৬৬ ভোট। কিন্তু বিজয়ী কাউন্সিলর নূর মোস্তফা টিনুসহ ২১ প্রার্থীর কেউই এক অষ্টমাংশ ভোট পাননি। ফলে জামানাত বাজেয়াপ্ত হবে সবার।

নির্বাচনে মিষ্টি কুমড়া প্রতীকে ৭৮৯ ভোট পান টিনু। অন্যান্য প্রার্থীর মধ্যে টিনুর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যাডমিন্টন র‌্যাকেট প্রতীকের মো. আব্দুর রউফ ৭৭৩ ভোট, মো. আলী আকবর হোসেন চৌধুরী মিন্টু (কাঁটা চামচ) ৭৩৫ ভোট, মো. দেলোয়ার হোসাইন ফরহাদ (রেডিও) ৬১৭ ভোট, মো. শাহেদুল আজম শাকিল (ক্যাপ) ৫৯০ ভোট, মো. সেলিম রহমান (ঠেলাগাড়ি) ৫২৮ ভোট, মেহেরুন্নিছা খানম (ড্রেসিং টেবিল) ৫২৭ ভোট, মো. সামশেদ নেওয়াজ রনি (ঘুড়ি) ২০২ ভোট, মো. নাজিম উদ্দীন (কাঁচি) ৪৪৩ ভোট, বিএনপির একক প্রার্থী একেএম সালাউদ্দিন কাউসার লাবু (হেডফোন) ৪৪৪ ভোট, মমতাজ খান (পান পাতা) ৬ ভোট, কায়সার আহমেদ (প্রদীপ) ২৫৩ ভোট, মো. আবুল কালাম চৌধুরী (সূর্যমুখী ফুল) ২০৮ ভোট, শওকত ওসমান (এয়ারকন্ডিশনার) ৬২ ভোট, মো. নোমান চৌধুরী (ট্রাক্টর) ১১৪ ভোট, মো. আজিজুর রহমান (হেলমেট) ৪৯ ভোট, মো. নুরুল হুদা (ঝুঁড়ি) ১৫০ ভোট, কাজী মুহাম্মদ ইমরান (লাঠিম) ১৭৭ ভোট, মো. রুবেল ছিদ্দিকী (করাত) ৭৩ ভোট, মো. আলাউদ্দিন (টিফিন ক্যারিয়ার) ১৫৯ ভোট এবং মো. জাবেদ (স্ট্রবেরি) পান ৩৩ ভোট।

রাজনীতিসচেতন মানুষের মতে, সাধারণ মানুষ দিন দিন নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। কোনো ধরনের নিশ্চয়তা তাদের কেন্দ্রে টানতে পারছে না। দলীয় মনোনয়নে নিশ্চিত জয় ও পেশী শক্তির উত্থান মানুষের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ কমে যাওয়ার মূল কারণ। চকবাজারের মতো ওয়ার্ডে সরকারের নীতিনির্ধারকরা একজন পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিকে কাউন্সিলর হিসেবে জয়ী করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে কারাবন্দি অস্ত্র মামলার আসামি টিনু নির্বাচিত হয়েছেন।

আরও পড়ুন: ‘আওয়ামী লীগের তকমা’ লাগিয়ে রেকর্ড প্রার্থীর ভোটযুদ্ধ—নজর এখন চকবাজারে

অভিযোগ রয়েছে, ১৪ কেন্দ্রের ফল ঘোষণা করা হলেও কাপাসগোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ইভিএম মেশিন নষ্ট হওয়ার অজুহাতে নির্বাচন কমিশন অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। আর এতেই  ফলাফল জালিয়াতি করে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন কারাবন্দি টিনু।

নির্বাচনে কাউন্সিলর পদপ্রার্থী দেলোয়োর হোসাইন ফরহাদ তাঁর ফেসবুক পোস্টে লেখেন, কাপাসগোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের নির্বাচনি ফলাফল ঘোষণা না করে ইভিএম মেশিন নির্বাচন অফিসে নিয়ে যাওয়ার কারণ কি?

আরেক প্রার্থী কাজী মুহাম্মদ ইমরান (রাজিশ ইমরান) নিজের ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘ডেটলাইন ৭ অক্টোবর। ১৬ নম্বর চকবাজার ওয়ার্ড কাউন্সিলর উপনির্বাচন। তথাকথিত কর্তৃত্বের লড়াই ও নেতৃত্বের নির্বুদ্ধিতা। ক্ষমতার রাজনীতি, স্বার্থ, সমীকরণ ও হিসেব নিকেশ’।

অ্যাডভোকেট নোমান চৌধুরী নামের একজন লেখেন, ‘নির্বাচন কমিশনের বিধানমতে, ২১ প্রার্থীর কারো প্রাপ্ত ভোট মোট ভোটের আট ভাগের এক ভাগও হয়নি। সেক্ষেত্রে সকলের জামানত বাজেয়াপ্ত। ভোটও বাজেয়াপ্ত করে পুনর্নির্বাচন দেওয়া হোক।’

আরও পড়ুন: কিশোর গ্যাং—ছুরিকাঘাতে কাউন্সিলরের ছেলে খুন

এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সনাক ও টিআইবি চট্টগ্রাম নগরের সভাপতি আখতার কবির চৌধুরী আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, দিন দিন নির্বাচন নিয়ে মানুষের আগ্রহ কমে আসছে। চকবাজারের উপনির্বাচনে বিজয়ী ২১ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। বিষয়টি দেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচনের জন্য অশনিসংকেত। ভোটারকে কেন্দ্র টানতে না পারা নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ব্যর্থতা। এভাবে চলতে থাকলে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা চিন্তার  বিষয়। এটি নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি এবং সংস্থার জন্য গবেষণার বিষয়।

তিনি আরও বলেন, ‘কিশোর গ্যাং’ নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ থাকা ব্যক্তি কারাগারে বসে কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হওয়াটাও শঙ্কার বিষয়। চকবাজারের মতো একটি ওয়ার্ডে একজন ক্লিন ইমেজের ব্যক্তিকে জিতিয়ে আনতে না পারাটা সরকারদলের ব্যর্থতা।

সিএম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!