‘অস্থির’ চিনির বাজার, রমজান টার্গেটে চলছে গোপন ‘মজুদ’

সিন্ডিকেটের 'কুনজর' এবার চিনিতেই

কয়েক দফা দাম বাড়ানোর পরও বাজারে নির্ধারিত দামে মিলছে না চিনি। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে চিনির বাজার এখন কৃত্রিম সংকটের মুখে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাড়তি দামে হিমশিম খাওয়া সাধারণ মানুষের কাছে ‘জুজুর ভয়’ সেই চিনি।

তবে এবার আরেক দফা দাম বৃদ্ধির ঘোষণায় চিনির মজুতকাণ্ডে মেতে উঠেছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে ছাড়ছে না প্যাকেট চিনি। তাই রমজানকে সামনে রেখে অস্থিরতার দিকে যাচ্ছে দেশের চিনির বাজার। আর এ নিয়ে শঙ্কিত সাধারণ ক্রেতারা।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নগরের বিভিন্ন খুচরা বাজারে চিনি কিনতে গিয়ে একটু কম দামের আশায় ক্রেতারা ঘুরছেন এক দোকান থেকে অন্য দোকানে। তবে কোথাও নির্ধারিত দামে মিলছে না চিনি। কোনো কোনো দোকানে চিনি বিক্রি হচ্ছে নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে। আবার কোনো দোকানে প্যাকেটজাত চিনি না পেয়ে বাড়তি দামে ক্রেতারা কিনছেন খোলা চিনি। এছাড়া খোলা বা প্যাকেট চিনি দুটির একটিও না পেয়ে এ দোকান থেকে ও দোকান ঘুরছেন ক্রেতারা। তবে অধিকাংশ দোকানে খুচরায় প্রতিকেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১৫ টাকা থেকে ১২০ টাকায়। আবার কয়েকটি দোকানে ১২২ থেকে ১২৫ টাকা।

নগরের চকবাজারে কথা হয় চিনি কিনতে আসা স্কুলশিক্ষক মো. জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে। তিনি আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, ২-৩ মাস ধরে চিনির দাম কয়েক দফা বাড়ানো হলো। তবে আশ্চর্যজনক বিষয়, দাম বাড়ানোর পর চিনির যে দাম নির্ধারণের খবর আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি সেই দামে কিন্তু দোকান থেকে চিনি কিনতে পারছি না । প্রতিবারই দোকানিরা নির্ধারিত দামের চেয়ে বাড়তি দামে চিনি বিক্রি করছেন। এবারও নির্ধারিত নতুন দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, সামনে আসছে রমজান মাস। রমজানে রোজাদারদের ইফতার-সেহেরিতে শরবতসহ অনেক খাবারে চিনির প্রয়োজন পড়ে। দাম নিয়ে যদি এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি চলতে থাকে তাহলে রোজায় চিনি ছাড়া শরবত খেতে হবে। না হয় বাদ দিতে হবে।

এদিকে গত ২৬ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত চিনির মূল্য বৃদ্ধিসহ কয়েকটি কারণ দেখিয়ে দেশের বাজারে আরেক দফা চিনির দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন। পরে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে কেজিতে ৫ টাকা বাড়িয়ে চিনির নতুন দর নির্ধারণ করা হয় ১০৭ টাকা (খোলা) ও ১১২ টাকা (প্যাকেট)। চিনির নতুন এ দর ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার কথা জানায় মিল মালিকদের সংগঠন।

তবে দাম বৃদ্ধির ঘোষণার পর থেকে ব্যবসায়ীরা চিনি নিয়ে ‘ছিনিমিনি’ খেলায় মেতেছে। রমজান মাসকে সামনে রেখে অতিরিক্ত মুনাফার আশায় চিনির বিশাল মজুত গড়ে তুলেছেন ব্যবসায়ীদের একাংশ। আবার আরেক অংশ নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে বাজারে বিক্রি করছেন চিনি। এতে বিপাকে পড়েছেন খুচরা ব্যবসায়ী ও সাধারণ ক্রেতারা।

বাড়তি দামে চিনি বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে বহদ্দারহাট এলাকার মুদি ব্যবসায়ী দিদারুল আলম আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, আমরা চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজার থেকে চিনি কিনে ক্রেতাদের কাছে খুচরায় বিক্রি করি। গত ২৬ জানুয়ারি চিনির দাম বাড়ার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে পাইকারিতে চিনির দাম বেড়ে গেছে। আগে পাইকারিতে ৫০ কেজির এক বস্তা চিনি কিনতাম ৫ হাজার ২৫০ টাকায়। দাম বৃদ্ধির ঘোষণার পর এখন কিনতে হচ্ছে ৫ হাজার ৪শ থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকায়। অর্থাৎ প্রতিকেজি খোলা চিনিতে পাইকারি দাম পড়ছে ১০৮-১১০ টাকা। অথচ নতুন নির্ধারিত দামে প্রতিকেজি খোলা চিনির খুচরা দাম নির্ধারণ করা হয় ১০৭ টাকা। আমাদের বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে বলেই ক্রেতাদের কাছে বাড়তি দামে বিক্রি করছি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাইকারি চিনি বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান এম কে এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপক আব্দুর রউফ আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, পাইকারি বাজারে অতিরিক্ত মূল্যে চিনি বিক্রির বিষয়টি পুরোপুরি সঠিক নয়। নতুনভাবে চিনির দাম বৃদ্ধির ঘোষণার পর থেকে বাড়তি মুনাফার লোভে হয়ত কিছু অসাধু ব্যবসায়ী খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বাড়তি দামে চিনি বিক্রি করছেন। তবে আমরা নির্ধারিত দামে খুচরা বাজারে চিনি সরবরাহ করে আসছি। বাজারে চিনির সংকট রয়েছে। এছাড়া প্যাকেট চিনির সংকট আরও প্রকট। সংকট দূর করতে সরকার কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে আগামী রমজান মাসে চিনির দাম সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে যাবে এবং বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হবে।

এসব বিষয়ে জানতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলার সহকারী পরিচালক নাসরিন আক্তারের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, দেশে বছরে ১৮ থেকে ২০ লাখ টন পরিশোধিত চিনির চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১ লাখ টন চিনি দেশের রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলো উৎপাদন করে থাকে। চাহিদার বাকিটা আমদানির মাধ্যমে মেটাতে হয়। মূলত অপরিশোধিত চিনি বিদেশ থেকে আমদানি করে দেশি মিলে পরিশোধন করে দেশের বাজারে সরবরাহ করা হয়।

দেশে গত বছরের জুলাই-আগস্টের দিকে চিনির বাজারে অস্থিরতা দেখা দিলে সেই বছরের সেপ্টেম্বরে প্রথমবারের মতো চিনির দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। এরপর ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে একই বছরের ৬ অক্টোবর চিনির দর কেজিতে আরও ৬ টাকা বাড়িয়ে খোলা চিনি কেজি ৯০ টাকা এবং প্যাকেট চিনি কেজি ৯৫ টাকা নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পরের মাসের ১৭ নভেম্বর আরেক দফা কেজিতে ১২ টাকা বাড়িয়ে খোলা চিনির দর নির্ধারণ করা হয় ১০২ টাকা এবং প্যাকেট চিনি ০৭ টাকা।

এরপর সর্বশেষ চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি আবারো বাড়ানো হয় চিনির দাম। এবার কেজিতে ৫ টাকা বাড়িয়ে খুচরা বাজারে খোলা চিনি ১০৭ টাকা এবং প্যাকেট চিনি কেজি ১১২ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

আরবি/আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!