ছোঁয়াচে রোগ বার্ড ফ্লু’র আঘাত ভারতে, শঙ্কায় বাংলাদেশ

ভারতে বার্ড ফ্লু রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। দেশটির দিল্লি, কেলারা, মধ্যপ্রদেশ, হিমাচল গুজরাট, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্রসহ প্রায় ১১টি রাজ্যের হাঁস-মুরগি ও পাখিজাতীয় প্রাণীর মধ্যে ভাইরাসজনিত এ রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশেও এ রোগ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিথি পাখিসহ নানা মাধ্যমে বাংলাদেশের হাঁস-মুরগি ও পাখি জাতীয় প্রাণীর মধ্যে বার্ড ফ্লু ছড়িয়ে পড়তে পারে। যাতে আক্রান্ত হতে পারে মানুষও। তাই দেশে এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব রুখতে ভারত থেকে হাঁস-মুরগি, ডিমসহ যেকোনো গৃহপালিত পাখি আনা বন্ধের পাশাপাশি এ ভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাক্সিন কার্যক্রম অব্যাহত রাখাসহ সব ধরণের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

জানা যায়, ভারতের মতো বাংলাদেশে যেন বার্ড ফ্লু রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা না দেয় সেজন্য সীমান্ত দিয়ে হাঁস-মুরগি, ডিম ও অন্যান্য গৃহপালিত পাখির প্রবেশ বন্ধে কয়েকদিন আগে স্বরাষ্ট্র, নৌ পরিবহন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালকে চিঠি দিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ভারত থেকে হাঁস-মুরগি, ডিমসহ গৃহপালিত পাখি আমদানি নিষিদ্ধের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানায়। যদিও আমদানি নিষিদ্ধে এখনো কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি করতে কাজ করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এজন্য খুঁটিনাটি বিষয় তদারকি করছে এ মন্ত্রণালয়। এছাড়া কী পরিমাণ মুরগি বা ডিম ভারত থেকে দেশে আনা হয় এবং এসব আমদানি নিষিদ্ধ করলে দেশে কোনো সমস্যা দেখা দিবে কি-না জানতে চেয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বার্ড ফ্লু একটি ভাইরাসজনিত ছোঁয়াচে রোগ। এ ভাইরাসের জীবাণু আক্রান্ত হাঁস-মুরগি বা অন্যান্য পাখির মল, রক্ত ও শ্বাসনালীতে বাস করে। নানা ঘটনাপ্রবাহে মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত হাঁস-মুরগি বা পাখি জবাইসহ পালক ছাড়ানোর জন্য নড়াচড়ার কারণে মানুষের মধ্যে এ ভাইরাসের সংক্রমণ হতে পারে। আবার শিশুরা আক্রান্ত বা মৃত হাঁস-মুরগি বা পাখি নিয়ে খেলা করলে ভাইরাসজনিত এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। জ্বর, সর্দি ও কাশির মাধ্যমে শুরু হওয়া এ রোগ মারাত্মক নিউমোনিয়ার রূপ ধারণ করে মৃত্যু ঘটাতে পারে।

তথ্য পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ১৯৯৭ সালে হংকংয়ে প্রথম মানবদেহে এ ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এরপর ২০০৩ সালের মাঝামাঝিতে হাঁস-মুরগির মধ্যে এ ভাইরাস ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে। সে বছরের ডিসেম্বরের দিকে লক্ষ্য করা যায়, অসুস্থ মুরগির সংস্পর্শে আসা মানুষও এ ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে।

২০০৭ সালের ২২ মার্চ সাভারে বাংলাদেশ বিমানের হ্যাচারিতে এ দেশে প্রথম বার্ড ফ্লু ধরা পড়ে। এর কয়েকদিনের মধ্যেই এ এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে ওই সময় ১০ লাখেরও বেশি মুরগি মারা যায় এবং মেরে ফেলা হয়। অসংখ্য আক্রান্ত হাঁস-মুরগি ধ্বংস করা হয়। এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আগে সে সময় দেশে খামারের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার। এর মধ্যে অসংখ্য খামার বন্ধ হয়ে বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। সে সময় এ সেক্টরে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে যায়।

২০০৮ সালের জানুয়ারিতে ১৬ মাস বয়সী এক শিশু দেশে প্রথমবারের মতো বার্ড ফ্লু রোগের ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। তবে পরবর্তীতে সে সুস্থ হয়ে উঠে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে আর কোনো মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি। ২০১৩ সাল থেকে দেশে এ রোগের টিকার ব্যবহার চলছে। এছাড়া দেশে ২০১৭ সালের পর থেকে কোথাও এইচ৫এন১ ভাইরাসে আক্রান্তের খবর পাওয়া যায়নি।

জীববিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি মিক্সোভাইরাস পরিবারের অন্তর্গত অর্থোমিক্স উপপরিবারের সদস্য, যাকে প্রাথমিক বিভাজনে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস বলা হয়। এ ভাইরাসের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো— এটি প্রতি মুহূর্তে নিজেকে বদলাতে পারে। ফলে কোনো সুনির্দিষ্ট টিকা এও ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকরী নাও উঠতে পারে। মহামারি সৃষ্টির জন্য একটি ভাইরাসের তিনটি গুণ থাকা দরকার। প্রথমটি হলো— কার্যকরভাবে মানবদেহে সংক্রমণ ঘটানো, দ্বিতীয়— মানবদেহে টিকে থাকার ক্ষমতা এবং তৃতীয়—মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হওয়ার যোগ্যতা। এ তিনটি গুণই রয়েছে বার্ড ফ্লু রোগের এইচ৫এন১ ভাইরাসের মধ্যে।

এদিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে ইতোমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় এইচ৫এন১ (বার্ড ফ্লু) ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ায় দেশের খামারিদের মধ্যে দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে প্রায় ৮৮ হাজার পোল্ট্রি খামার রয়েছে। এসব খামারে গড়ে প্রতিদিন প্রায় সোয়া ২ কোটি ডিম উৎপাদিত হয়। এছাড়া প্রতিদিন মুরগির মাংস উৎপাদিত হয় প্রায় দেড় হাজার মেট্রিক টন। পোল্ট্রি খামারের এসব মাংস ও ডিম দেশের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের আমিষের চাহিদার বেশিরভাগ পূরণের পাশাপাশি অসংখ্য নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তাছাড়া করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে দেশের পোল্ট্রি শিল্পের

এবার ভারত থেকে এইচ৫এন১ ভাইরাস বাংলাদেশে প্রবেশ করে দেশের খামারগুলোর হাঁস-মুরগিতে ছড়িয়ে পড়লে এ শিল্পের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও বড় ধরণের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রাণিস্বাস্থ্য শাখা) ডা. মো. নাজমুল হক আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, আমাদের দেশে যেহেতু বার্ড ফ্লু এখনো আসেনি তাই আমরা প্রস্তুত আছি যেন না আসে। বার্ড ফ্লু হলে খাওয়া যাবে না, না হলে খাওয়া যাবে এমনটাও বলা যাবে না। কারণ বার্ড ফ্লু হলো আসলে এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জা। বার্ড ফ্লুর মধ্যে বিভিন্ন ধরন রয়েছে। যেটা এইচ৯এন২ সেটা যেকোনো বার্ডে যেকোনো সময় থাকতে পারে। এটা ন্যাচারালি থাকে। এইচ৯এন২ কমন, এটা যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায়। এটা মারাত্মক কিছু না। তবে এইচ৫এন১ মারাত্মক। এইচ৫এন১ এখনো আমাদের দেশে নেই। এটা সচরাচর পশুতে সংক্রমিত হয় না, তবে হাঁস-মুরগি বা অন্যান্য পাখি থেকে এটা মানুষে সংক্রমিত হতে পারে।

তিনি বলেন, ২০০৭ সাল থেকে শুরু করে আমাদের দেশে এইচ৫এন১ বিরাজ করেছিল অনেকদিন। আল্লাহর রহমতে দেশে কেবল একজন মানুষের মধ্যেই এ মারাত্মক ভাইরাস পাওয়া যায় এবং ভাগ্য ভালো যে ওই একজন থেকে অন্য কারো মধ্যে এটা ছড়ায়নি। এটা কিন্তু বার্ড থেকে মানুষে ডিরেক্টলি আসে না। যে কয়জন আক্রান্ত বার্ডের সংস্পর্শে যায় কেবল তাদের মধ্যে আসতে পারে। কিন্তু আক্রান্ত মানুষ থেকে মানুষে বেশি ছড়ায়।

ডা. হক বলেন, মারাত্মক এইচ৫এন১ আমাদের দেশে এখন নেই, না আসার জন্য আমরা প্রস্তুত আছি। ভ্যাক্সিন আমদানির জন্যও আমরা কাজকর্ম করে যাচ্ছি। যেহেতু পাশের দেশে এটা পাওয়া গেছে তাই আমাদেরও একটা ঝুঁকি থেকেই যায়। তবে তাই বলে যে হাঁস-মুরগি খাওয়া যাবে না সেটাও বলা যাবে না। ঝুঁকি এড়াতে আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি।

এসআই/আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!