চট্টগ্রাম কাঁপানো দুদক কর্তার বদলি রহস্যে বেঁচে যাচ্ছেন ‘রাঘববোয়ালরা’

চট্টগ্রাম কাঁপানো দুদক কর্মকর্তার বদলির রহস্যে বেঁচে যেতে পারেন ‘রাঘববোয়ালরা’। দুদকের উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনের বদলির আদেশকে ঘিরে তৈরি হয়েছে এ শঙ্কা। এ নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন।

এর আগে চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান (বর্তমানে পৌরসভার মেয়র) থেকে সনদ পাওয়া ১৩ রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন দুদক কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিন। এ মামলায় অভিযুক্ত করা হয় কক্সবাজার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাসহ জেলার বিশেষ শাখার তিন পুলিশ পরিদর্শককে। কিন্তু মামলা দায়ের হওয়ার পরই বদলি করা হয় দুদকের এই আলোচিত কর্মকর্তাকে।

এদিকে তাঁর বদলির আদেশের কারণে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা ভোটার হওয়ার তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। একইসঙ্গে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখবে কি-না তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় অভিযুক্ত রাঘববোয়ালরা পার পেয়ে যেতে পারেন বলেও সংশ্লিষ্ট অনেকে শঙ্কা করছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কক্সবাজার মেগা প্রকল্পের ৩ দশমিক পাঁচ লাখ কোটি টাকার সরকারি ভূমি অধিগ্রহণের অনিয়মের তদন্ত করছেন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিশাল মেগা প্রকল্পের অনিয়মের মূলহোতা কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান। চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় তিনি দুইশ রোহিঙ্গাকে ভোটার করেছিলেন। তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন স্মার্ট কার্ড। ভোটার হওয়ার সুবাদে রোহিঙ্গাদের অনেকেই বানিয়েছে পাসপোর্ট।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে মেয়র মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি তদন্ত প্রতিবেদনও জমা দেয় দুদক অনুসন্ধান কর্মকর্তারা। চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় মুজিবুর রহমান থেকে সনদ পাওয়া এসব রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে সম্প্রতি মামলা দায়ের করেন দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-২ এর উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন।

কিন্তু মামলা দায়ের পরই বদলির আদেশ আসে দুদকের ওই কর্মকর্তার। আদেশে তাঁকে পটুয়াখালী দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে বদলি করা হয়। তবে গুঞ্জন আছে, এই বদলির নেপথ্যে রয়েছেন স্বয়ং কক্সবাজারের মুজিবুর রহমান!

এদিকে চট্টগ্রামের দুদকের এই কর্মকর্তার পুরস্কারের পরিবর্তে শাস্তিমূলক বদলির আদেশ অযৌক্তিক, অন্যায় উল্লেখ করে গত ২১ জুন দুদক চেয়ারম্যান বরাবরে লিখিত আবেদন করেন কক্সবাজারের জাগ্রত সমাজের পক্ষে ফজলে আজিম মোহাম্মদ ছিবগাতুল্লাহ।

এ বিষয়ে ফজলে আজিম মোহাম্মদ ছিবগাতুল্লাহ আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, অবৈধ উপায়ে এনআইডি ও পাসপোর্ট পাওয়া রোহিঙ্গা নাগরিকদের বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত শুরু করেন দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন। মামলা দায়ের করার পরই তাঁকে বদলি করা হলো। তাই কক্সবাজারের জাগ্রত সমাজের পক্ষে এ বদলি প্রত্যাহার চেয়ে মহামান্য হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয়।

তিনি আরও বলেন, এ কর্মকর্তা বদলি হলে গুরুত্বপূর্ণ এসব মামলায় বড় ধরনের প্রভাব পড়ার শঙ্কা তৈরি হবে। দেশের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি সদয় বিবেচনা করবেন বলে আমি মনে করি।

ফজলে আজিম মোহাম্মদ ছিবগাতুল্লাহ বলেন, রিটে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার দুটি তদন্তের ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া সাপেক্ষে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে সময় দিতে আবেদন করা হয়। কিন্তু সমাধান না পেয়ে গত ২৯ জুন মহামান্য হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করা হয়। যার নম্বর ৫৯০২/২০২১।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, সম্প্রতি কক্সবাজারের মেগা প্রকল্পের অনিয়মের তদন্ত করতে গিয়ে কক্সবাজারের মেয়র মুজিবুর রহমানের রোষাণলে পড়েন দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন। মেয়র মুজিব ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা লড়তে দাঁড় করিয়েছেন যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশের স্ত্রী অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা জুতিকে।

এদিকে গত ১৪ জুলাই বিচারপতি এনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের দ্বৈত বেঞ্চে এ রিট আবেদনটি খারিজ করে দেওয়া হয়। পরে এ রিটের উপর আবার আপিল করা হয়। গত ১৯ জুলাই এ রিটের পিটিশনের উপর শুনানি হয় বিচারপতি একেএম ওবায়দুল হাসানের আদালতে। যার পিটিশন নম্বর ৩২২/২০২১। আগামীকাল ২৭ জুলাই এ রিট পিটিশনের রায় দেওয়ার কথা রয়েছে।

আরও পড়ুন: ‘হুমকিতে দেশ’—রাতারাতি ৫৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশি ভোটার, দুদকের জালে ইসির ৪ লোক

প্রসঙ্গত, গত ১৬ জুন বিকেলে দুদক প্রধান কার্যালয়ের পরিচালক মুহাম্মদ মনিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে দুদক কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিনকে বদলির আদেশ দেওয়া হয়। তাঁর জায়গায় চট্টগ্রাম-১ থেকে আনা আরেক কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এদিকে দুদক কমিশন বলছে, দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনকে রুটিন বদলি করা হয়েছে। দুদক কর্তৃপক্ষের আইন মোতাবেক একই স্থানে তিন বছর সময় চাকরিকাল অতিবাহিত হলে তার অন্য জায়গায় বদলি নিয়মিত রুটিন।

তবে দুদক কমিশন এই বদলিকে ‘নিয়মিত রুটিন’ বললেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। চট্টগ্রামে দুদকের আরও অনেক কর্মকর্তা রয়েছেন যারা চার বছরেরও বেশি সময় ধরে চট্টগ্রামে রয়েছেন।

জানা যায়, কক্সবাজার মেগা প্রকল্পের ৩ দশমিক ৫ লাখ কোটি টাকার সরকারি ভূমি অধিগ্রহণের তদন্তের দায়িত্বভার পড়ে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিনের উপর। তদন্তের পর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে করা মামলায় এ পর্যন্ত ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে দুদক। এর মধ্যে ৫ জন অভিযুক্ত ফৌজদারী কার্যবিধি মোতাবেক ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। এ মামলায় অভিযুক্তদের তালিকায় আছেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ রাজনৈতিক নেতা, অ্যাডভোকেট, সাংবাদিকসহ আরও অনেকে।

এ মেগা প্রকল্পের তদন্তের শেষ মুহূর্তে ১৬৪ ধারায় অভিযুক্ত প্রশাসনের বড় বড় কর্মকর্তা ও পুলিশ ক্যাডারের ২১ জন কর্মকর্তাকে মামলার বিষয়ে বক্তব্যে দিতে দুদক থেকে নোটিশ পাঠানো হয়। কিন্তু অভিযুক্তরা তদন্ত কর্মকর্তার কাছে না এসে দুদক প্রধান কার্যালয়ের প্রশাসন ক্যাডার থেকে ডেপুটেশনে আসা পরিচালক, মহাপরিচালক ও সচিবের যোগসাজশে ওই তদন্ত কর্মকর্তাকে বিভিন্নভাবে চাপ দেন।

এরই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের ১৬ জুন বিকেলে ২১ জনের আদেশের মধ্যে দুদকের রুটিন বদলির আড়ালে পটুয়াখালিতে বদলি করা হয় দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনকে।

দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন গত ১০ জুন অবৈধ গ্যাস সংযোগ ও নতুন করে রাইজার উত্তোলনের কারণে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) শীর্ষ ৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। এদিন অভিযান পরিচালনা করে কেজিডিসিএলের প্রকৌশলী মো. সারওয়ার হোসেন, ব্যবস্থাপক মো. মজিবুর রহমান এবং সার্ভেয়ার মো. দিদারুল আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন বিচ্ছিন্ন করা হয় কেজিডিসিএলের অবৈধ গ্যাস সংযোগগুলো।

এদিকে ১২ থেকে ১৬ জুন পর্যন্ত কক্সবাজারে রোহিঙ্গা নাগরিকদের ১৫টি পাসপোর্ট দেওয়ায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ৪টি মামলা দায়ের করেন দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন। এর মধ্যে একটি মামলায় অভিযুক্তরা হলেন— সাবেক চট্টগ্রাম সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও বর্তমানে ঢাকা নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের পরিচালক খোরশেদ আলম, কক্সবাজার রামু উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মাহফুজুল ইসলাম, চট্টগ্রাম সিনিয়র জেলা নির্বাচন অফিসার কার্যালয়ের অফিস সহকারী বর্তমানে পটিয়া উপজেলা নির্বাচন অফিসারের কার্যালয়ের অফিস সহকারী রাসেল বড়ুয়া এবং পাঁচলাইশ থানা নির্বাচন অফিসার কার্যালয়ের সাবেক টেকনিক্যাল এক্সপাট মো. মোস্তফা ফারুক।

আরও পড়ুন: সম্পদের পাহাড়— দুদকের জালে নবতারা নূপুর

এসব মামলার মধ্যে তিন কাউন্সিলর ও পৌরসভার এক কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করে দুদকের এই কর্মকর্তা। এছাড়া ভোটার হালনাগাদ কাজে ব্যবহৃত ডেল লাতিটিউড ৬৩০, পরিসেবা ট্যাগ নম্বর-জিওয়াইএসপিএস-৪২১৪ ব্রান্ডের ল্যাপটপটি আত্মসাৎ করে নির্বাচন কমিশনের অভিযুক্ত কর্মচারী। রোহিঙ্গাসহ ৫৫ হাজার ৩১০ জনকে অবৈধভাবে ভোটার করার দায়ে গত ১৭ জুন ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন।

রোহিঙ্গা এনআইডি ও পাসপোর্টের বিষয়ে তিনি ১০টি মামলার বাদি এবং আরও ১০টি অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। এর বাইরে চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার রোহিঙ্গা এনআইডি, স্মার্ট কার্ড, ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তিকরণ ও পাসপোর্ট প্রাপ্তির বিষয়ে অনুসন্ধান প্রায় শেষ পর্যায়ে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা পাসপোর্ট মামলায় আরও ৩০ হাজার রোহিঙ্গা পাসপোর্ট পেয়েছেন মর্মে এসব মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়।

জানতে চাইলে চকরিয়া উপজেলা আর্ন্তজাতিক মানবাধিকার সংস্থার সভাপতি শহীদুল ইসলাম লিটন আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়ছেন। তদন্ত করে রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। তাঁকে পুরস্কারের পরিবর্তে উল্টো শাস্তিমূলক বদলি করা হলো। তিনি বদলি হয়ে গেলে গুরুত্বপূর্ণ এ মামলাগুলো আর আলোর মুখ দেখবে না। তাঁর বদলি দুদক কর্তৃপক্ষের রুটিন মোতাবেক হয়নি। চট্টগ্রামে দুদকের আরও অনেক কর্মকর্তা রয়েছেন যাদের চাকরির বয়স সাড়ে চার বছরেরও বেশি হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দুদক প্রধান কার্যালয়ের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) খোরশেদ আলম আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, বিষয়টি একটু খোঁজ নিতে হবে।

আরবি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!