চট্টগ্রামে বাড়ছে আত্মহনন, যে কারণে ইপিজেডে সবচেয়ে বেশি ‘আত্মহত্যা’

চট্টগ্রামে বাড়ছে আত্মহনন। নগরের ১৬ থানায় প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে আত্মহননের ঘটনা। তবে এর মধ্যে ইপিজেড ও চান্দগাঁও এলাকায় আত্মহননের হার সবচেয়ে বেশি। আর সবচেয়ে কম চকবাজারে। তরুণ-তরুণীদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি আত্মহননের প্রবণতা।

সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, পারিবারিক কলহ, আর্থিক অনটন, পরকীয়া, স্বামীর বহু বিবাহ ও প্রেমসহ নানা কারণে আত্মহননের ঘটনা ঘটছে। এ অবক্ষয় থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র যার যার জায়গা থেকে কাজ করতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, আত্মহত্যা প্রবণতার ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম।

দেশীয় বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী, দেশের মধ্যে আত্মহত্যার শীর্ষে রয়েছে ঢাকা বিভাগ। এ বিভাগের ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত আত্মহত্যার হার ৩১ দশমিক ৩০ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ। এখানে আত্মহত্যার হার ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। এছাড়া খুলনা বিভাগে ১৩ শতাংশ, রংপুরে ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ, ময়মনসিংহে ১০ শতাংশ, রাজশাহীতে ১১ দশমিক ৯০ শতাংশ, বরিশালে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং সিলেটে ২ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে ৩৬১ জন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) তথ্যমতে, ২০২১ সালে নগরে ৩৯৭টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ২০২২ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫২৬ জনে। চলিত বছরের আগস্ট পর্যন্ত ৮ মাসে নগরে আত্মহত্যা করেছে ১৬৩ জন।

প্রাপ্ত তথ্য বলছে, নগরের ১৬টি থানার মধ্যে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি ইপিজেড এলাকায়। গত আট মাসে এ থানা এলাকায় আত্মহত্যা করেছে ২৪ জন!

এর পরেই রয়েছে চান্দগাঁও। গত আট মাসে এ থানা এলাকার ১৯ জন আত্মহত্যা করেছেন। তবে সবচেয়ে কম চকবাজার এলাকায়। সেখানে গত আট মাসে আত্মহত্যা করেছন মাত্র ২ জন। এছাড়া কোতোয়ালীতে ১৫ জন, বন্দরে ১৫ জন, পাঁচলাইশে ১২ জন, বায়েজিদে ১২ জন, খুলশিতে ৯ জন, হালিশহরে ৯ জন, পাহাড়তলীতে ৯ জন, কর্ণফুলীতে ৯ জন, বাকলিয়া ৯ জন, ডবলমুরিংয়ে ৭ জন, আকবরশাহ ৪ জন এবং পতেঙ্গায় ৪ জন আত্মহত্যা করেছেন।

সিএমপির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছর ১৬ থানায় জানুয়ারিতে আত্মহত্যা করেছে ২১ জন। এছাড়া ফেব্রুয়ারিতে ১৭ জন, মার্চে ২০ জন, এপ্রিলে ২২ জন, মে’তে ২২ জন, জুনে ১৮ জন, জুলাইয়ে ১৯ জন এবং আগস্টে ২৪ জন। এ হিসাবে নগরে প্রতিমাসে গড়ে ২০ দশমিক ৩৭ জন আত্মহত্যা করেছে।

ইপিজেড এলাকায় আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি থাকার বিষয়ে সিএমপির উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি পোর্ট) শাকিলা সোলতানা আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, ইপিজেড গার্মেন্টস অধ্যুষিত এলাকা। এখানে বসবাসকারীদের বেশিরভাগ বিভিন্ন জেলা থেকে আসা। তাদের বেশিরভাগ পোশাক শ্রমিক, অশিক্ষিত ও নিম্ন আয়ের মানুষ। পারিবারিক ও অর্থিক অবস্থা বিবেচনায় তাদের বেশিরভাগই মৌলিক চাহিদা পূরণে অক্ষম। ফলে তাদের মধ্যে বিষন্নতা কাজ করে। পারিবারিক কলহ, কাজের অনিশ্চয়তা, আর্থিক অনটন, পরকীয়া, স্বামীর বহু বিবাহ, প্রেমসহ নানা কারণে তারা আত্মহত্যা করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সমাজবিজ্ঞানী ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, সম্প্রতি চট্টগ্রামে আত্মহত্যা ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। মানুষের আত্মাহুতির তিনটি ধরন রয়েছে। এর মধ্যে প্রথমত, প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রাপ্তি যোগ হয় না এবং স্বপ্ন যা দেখছে তা পূরণ হয় না। এদের মধ্যে শিক্ষার্থী ও তরুণ-তরুণীরা রয়েছে। যেমন চাহিদা অনুযায়ী রেজাল্ট না পাওয়া, পছন্দের মোবাইল, মোটরসাইকেল বা কোনো জিনিস চেয়েও না পাওয়া।

দ্বিতীয়ত, কিছু লোক আছে যারা দেশ ও দেশের স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রদ্রোহীদের হামলার শিকার হয়ে শহীদ হন। এটি সামাজিক অবক্ষয় না হলেও একধরণের আত্মাহুতি।

তৃতীয়ত, কিছু লোক আছেন, যারা পারিবারিক কলহ, দারিদ্রতা, ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা, পরকীয়া, স্বামীর বহু বিবাহ, একাধিক প্রেমসহ বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যা করেন। সমাজে এ ধরনের বসবাসকারীদের মাঝে সবসময় হতাশা কাজ করে। সঠিক গাইডলাইন না থাকায় একটি পর্যায়ে তারা আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হন। এ ধরণের মানুষের মধ্যে বেশিরভাগ গার্মেন্টস কর্মী ও নিম্ন আয়ের মানুষ।

তিনি আরও বলেন, আত্মহত্যা একটি সামাজিক অবক্ষয়। এই অবক্ষয় থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র যার যার জায়গা থেকে কাজ করতে হবে। সবার মধ্যে সচেতনা বাড়তে হবে। তবেই কেবল আত্মহত্যা কমিয়ে আনা সম্ভব।

আরবি/আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!