যুবকের হাত-পা ভেঙে পুলিশ ডেকে ‘অন্যের’ অস্ত্র হাতে তুলে দিলেন চেয়ারম্যান

শেখেরখীল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. ইয়াসিন। এলাকায় লোকে তাকে চিনে ‘ডাকাত ইয়াসিন’ হিসেবে। তবে আওয়ামী লীগের ব্যানারে নির্বাচনে জিতে নেতা বনে যাওয়ার পর হয়ে ওঠেন আরও বেপরোয়া।

বুধবার (৭ জুলাই) জামানতের টাকা ফেরত চাওয়ার জের ধরে এক অটোরিকশা চালককে মারধর করে হাত-পা ভেঙে দেন ইয়াসিন চেয়ারম্যান ও তার লোকজন। শুধু হাত-পা ভেঙেই ক্ষান্ত হননি অস্ত্র-গুলি দিয়ে অটোরিকশা চালককে ‘ডাকাত’ সাজিয়ে তুলে দেন পুলিশের হাতে।

পুলিশের হাতে দেওয়ার আগে অটোরিকশা চালকের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে ছড়িয়ে দেন চেয়ারম্যান ইয়াসিন।

ভুক্তভোগী অটোরিকশা চালকের নাম নুরুল কাদের (৫০)। তিনি বাঁশখালীর শেখেরখীল ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তবে গ্রামবাসীর প্রতিরোধের মুখে বুধবার রাতে তাকে ছেড়ে দেয় পুলিশ।

মুক্তির পর নুরুল কাদের বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন। এখন সেখানেই চলছে তাঁর চিকিৎসা। তবে নির্যাতনের শিকার নুরুলের স্ত্রী-সন্তানদের দিন কাটছে আতঙ্কে।

এ ঘটনার শুরু দুই বছর আগে। একই গ্রামের মৃত ছিদ্দিক আহমদের ছেলে নুরুল কাদেরের সঙ্গে নুরুজ্জামানের ছেলে আবু সামার বসতভিটা নিয়ে বিরোধ হয়। ওই ঘটনায় স্থানীয় চেয়ারম্যান ইয়াসিনের কাছে বিচার চাইলে তিনি দুইপক্ষকে ৫০ হাজার টাকা করে জমা দিতে বলেন। নুরুল কাদেরও তখন ৫০ হাজার টাকা জমা দেন। উভয়পক্ষের বিরোধ মীমাংসা হয়ে গেলেও নুরুলের টাকা ফেরত দেননি চেয়ারম্যান। বেশ কয়েকবার টাকা চাইতে গেলে নুরুলকে মারধর করেন চেয়ারম্যান ও তার লোকজন। এমনকি তাকে মেরে হাত-পাও ভেঙে দেওয়া হয় তখন।

চেয়ারম্যানের ভয়ে নুরুল আট মাস বাড়ির বাইরে ছিলেন। গত মাসে নুরুল বাড়িতে গেলে চেয়ারম্যান তাকে পিটিয়ে হাত ভেঙে দেন। এরপর তিনি পরিবার নিয়ে নাপোড়া গ্রামে ভাড়া বাসায় থাকা শুরু করেন। হাত ভেঙে যাওয়ায় তিনি কর্মহীন হয়ে পড়েন। এরপর থেকে শেখেরখীল বহদ্দারহাট রাস্তার মুখে তার বড় ছেলের ফার্নিচারের দোকানে বসতেন নুরুল।

জানা যায়, গত বুধবার দুপুর সাড়ে ৩টার দিকে ছেলের ফার্নিচারের দোকানের পাশে আলমগীরের চা দোকানে বসে চা পান করছিলেন নুরুল। এ সময় চেয়ারম্যান ইয়াসিন দলবল নিয়ে নুরুলকে মারতে মারতে দোকান থেকে বের করেন। একপর্যায়ে অটোরিকশায় উঠিয়ে দুই কিলোমিটার দূরে শেখেরখীল উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে নিয়ে যান। সেখানে ভাড়া দোকানে রয়েছে চেয়ারম্যানের অস্থায়ী কার্যালয়। ওই স্থানে নিয়ে কয়েকদফা পেটানো হয় নুরুলকে। এ সময় চেয়ারম্যানের সহযোগী ছিলেন ইকবাল, আলী হোসেন, ছগির, রিয়াজউদ্দিন, নুরুল কাদের। মারধরের পর তাঁকে দড়ি বেঁধে তার হাতে একটি দেশি এলজি ও ৫ রাউন্ড গুলি দিয়ে ছবি তোলা হয়। এরপর তাঁর ছবি কয়েকজন সাংবাদিকদের দেওয়া হয়।

উপস্থিত সাংবাদিকদের চেয়ারম্যান ইয়াসিন জানান, নুরুল কাদের অস্ত্র ও গুলি নিয়ে তাকে এবং তার লোকজনদের মারতে এসেছিল। গুলি করার সময় স্থানীয় জনতা নুরুলকে ধরে ফেলায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান।

পরে চেয়ারম্যান লোকজন দিয়ে অস্ত্র ও গুলিসহ নুরুল কাদেরকে বাঁশখালী থানা পুলিশের হাতে তুলে দেন।

এদিকে গ্রামবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার (আনোয়ারা সার্কেল) হুমায়ন কবির, বাঁশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. সফিউল কবির, থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি তদন্ত)  মো. আজিজুল ইসলামসহ পুলিশের আরও কয়েকটি দল ঘটনার তদন্ত শুরু করেন। তদন্ত শেষে ঘটনাটি যে চেয়ারম্যানের সাজানো তা জানতে পেরে নুরুল কাদেরকে বুধবার দিবাগত রাত ৩টায় ছেড়ে দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে ক্ষোভপ্রকাশ করে কয়েকজন এলাকাবাসী বলেন, আমরা আলমগীরের চা দোকানে ছিলাম। নুরুল কাদেরকে না পেটানোর জন্য আমরা চেয়ারম্যানকে অনেক অনুরোধ করি। কিন্তু তিনি আমাদের কথা শুনেননি। চেয়ারম্যান ইয়াসিনকে আগে লোকে চিনতো ‘ডাকাত ইয়াসিন’ নামে। অস্ত্র, হত্যা, ডাকাতিসহ বহু মামলার আসামি ইয়াসিন নৌকা প্রতীক পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এখন সে আগের মতো বর্বরতা দেখাচ্ছে। নিরীহ মানুষকে মেরে অস্ত্র-গুলি দিয়ে পুলিশে তুলে দিচ্ছে। আমরা চেয়ারম্যানকে গ্রেফতারের দাবি জানাই এবং ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই।

যোগাযোগ করা হলে বাঁশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. সফিউল কবির বলেন, ‘নুরুল কাদেরকে আমরা ছেড়ে দিয়েছি। নুরুলের সঙ্গে দেওয়া অস্ত্র ও গুলিগুলো কাদের এবং এর সঙ্গে কারা জড়িত তা তদন্ত করে মামলা করা হবে। ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষে অভিযোগ করা হলেও মামলা নেওয়া হবে।

সহকারী পুলিশ সুপার (আনোয়ারা সার্কেল) হুমায়ন কবির বলেন, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। বিষয়টি পুরোপুরি তদন্ত চলছে। তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

তবে শেখেরখীলের ইউপি চেয়ারম্যান মো. ইয়াসিনের কণ্ঠে ছিল অন্য সুর। তিনি বলেন, আমি অস্ত্র-গুলিসহ ডাকাত ধরিয়ে দিয়েছি। আপনারা এসব ভালো কাজে সহযোগিতা না করলে আমরা আগ্রহ হারাবো। ভালো কাজ করতে সহযোগিতা করুন।

উজ্জ্বল/ডিসি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!